আমার স্মৃতিতে বুড়িভাই (স্নেহলতা বড়ুয়া)

ভিক্ষু জ্ঞানবোধি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন –

বিশ্বে যাকিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যানকর,

অর্ধেক তাঁর করিয়াছে নারী, অর্ধেক তাঁর নর। (সঞ্চয়িতা, ৭৪)

কিন্তু আমাদের এই পুরুষপ্রধান সমাজে, একজন নারী দেশের, দশের কিংবা সমাজের কল্যানে যত অবদানই রাখুক না কেন, আমরা তাঁকে তাঁর উপযুক্ত সম্মান দিই না। নারীর প্রতি পুরুষজাতির এহেন অসামঞ্জস্য আচরনের প্রেক্ষিতে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীরা রয়েছেন পিছিয়ে। অথচ সেই মাতৃজাতি নারীই যুগে যুগে জন্ম দিয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত মনীষাদের। তাদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, মায়া-মমতা ও আদর-যত্ন বিহনে এই পৃথিবী হত শুস্ক মরুভূমির মত প্রাণহীন। মাতৃজাতির এই নির্লোভ, অক্লান্ত ত্যাগের মহিমা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি আরও লিখেছেন –

জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,

মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান। (সঞ্চয়িতা, ৭৫)

অধ্যাপক ডক্টর জিনবোধি মহাথেরের মাতা, প্রয়াত স্নেহলতা বড়ুয়া, যাকে আমরা – যারা উনার নাতীর বয়স্ক – বুড়িভাই বলে ডাকতাম, ছিলেন এমন এক মহীয়সী নারী, যার অকৃত্রিম ত্যাগে দেশ হয়েছে ধন্য এবং বৌদ্ধ-সমাজ হয়েছে গৌরবান্বিত। তিনি ছিলেন ত্যাগের যেন এক বিমূর্ত প্রতীক। তাঁর এ ত্যাগ প্রতিভাত হয় ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর এক সন্তানকে হারানোর মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে একজন মায়ের কাছে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে উনার তরুণ সন্তানের মৃত্যু-সংবাদ শোনা। সন্তান হারানোর বেদনা যে কি করুণ একমাত্র সেই জানে যিনি তা স্বয়ং উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু বুড়িভাই তাতে এতটুকুও ভেঙ্গে পড়েননি। সংসারকে টেনে নিয়ে গেছেন দৃঢ়তার সাথে, একটুও বিচলিত না হয়ে। কিভাবে তিনি এতটা সুদৃঢ় হতে পেরেছিলেন? তার একটিমাত্র কারন হতে পারে। তিনি ছিলেন স্বধর্মপ্রাণ ও স্থিরচিত্তের অধিকারী। তাইতো একজন সন্তানকে হারানোর পরও তিনি তাঁর আরেকজন সন্তানকে বুদ্ধ-শাসনে দান কতে দ্বিধা করেননি। যে কিনা বাঙ্গালী বৌদ্ধ সমাজে আজ অধ্যাপক ডক্টর জিনবোধি মহাথের নামে পরিচিত। এবং যিনি আজ বাঙ্গালী বৌদ্ধ জাতির উন্নয়ন কল্পে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ সংস্কারমূলক নানাকাজে নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছেন।

বুড়িভাইয়ের তিন ছেলের মধ্যে দু’জন যখন এভাবে ঘর ছেড়ে চলে যান, বাকিজন সংসারের হাল ধরেন। কিন্তু নিয়তির এমন পরিহাস, মরনব্যাধির কবলে পড়ে তাকেও মায়ের আঁচল ছেড়ে অকালে পাড়ি জমাতে হল পরপারে। এভাবে একাকী ছেলেবউ ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন। কিভাবে একজন নারী এমনভাবে ত্যাগ-মহিমায় উদ্দীপ্ত হতে পারেন? কি এমন শক্তির জোরে সে সদাপ্রানোদ্দীপ্ত হয়ে জীবন কাটাতে পারেন তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমি একটা কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি – তিনি ছিলেন একজন মহীয়সী নারী। ধর্মই ছিল তাঁর পথচলার একমাত্র সাথী। সেটা দেখা যায় তাঁর জীবনে। সারাজীবন সংসারের এত ব্যাস্ততার পরও কখনও কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান তিনি বাদ দেননি। বিশেষকরে রাঙ্গুনীয়ার যেকোনো মন্দিরে যেকোনো ধর্মসভাই হোক না কেন বুড়িভাই সেখানে উপস্থিত থাকতেন। ধর্মের প্রতি তাঁর এহেন অগাধ শ্রদ্ধা সম্ভবত তাঁকে মানসিক শক্তি যোগাত, যেটার প্রেক্ষিতে সে জীবনের সমস্থ ঝর-তুফান উপেক্ষা করে একটি শান্ত-সুসমাহিত ও সুন্দর জীবন পরিচালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

বুড়িভাইকে আমি কাছ থেকে দেখেছি ও জেনেছি ২০০১ সালে যখন আমি তাদের বিহারে থাকতে যাই। কদল্পুর ভিক্ষু প্রশিক্ষন কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক নানা কাজের চাপে আমার পড়ালেখা যখন প্রায় বন্ধ হতে চলল। যখন দেখছি পড়ালেখার সমস্ত দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন বন্ধু ভিক্ষু রাহুলানন্দের সহায়তায় আমি তাদের বিহারে চলে আসি। সেখানে আসার পর প্রায় এক বছরকাল আমি থেকেছি। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট করছি পাহাড়তলীর ইমাম গাজ্জালী ডিগ্রী কলেজে। বিহারে অবস্থানকালীন সময়ে প্রায় প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় চার/পাঁচজন বয়স্ক উপাসক ও উপাসিকা বিহারে আসতেন এবং বুদ্ধবন্দনাদি করে বিহারের বারান্দায় বসে নানা ধর্মীয় আলোচনায় ব্যাপ্ত থেকে সময় কাটাতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বুড়িভাই। বিহারে দু’এক দিনের মধ্যেই উনার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। প্রতিদিন বিহারে আসলেই তিনি আমাকে বলতেন – শ্রমন, আমাকে কিছু বন্দনা শিখিয়ে দাও।

আমি বলতামঃ            বুড়িভাই, আপনিতো অনেক বন্দনা জানেন, আর শেখার দরকার কি?

বুড়িভাই বলতেনঃ       আগে আরো বেশি জানতাম, এখন অনেক ভুলে গেছি।

উনার বয়স তখন প্রায় ৯০ বৎসর। আমি অবাক হতাম এবয়সেও উনার শেখার আগ্রহ দেখে।

অনেক প্রশ্ন করতাম বুড়িভাইকে। কখনও বিন্দুমাত্র বিরক্ত হতেন না। আমি জিজ্ঞেস করতাম – কত বছর বয়সে আপনার বিয়ে হয় বা আপনি এ গ্রামে কখন আসেন? কত ক্লাস পর্যন্ত আপনি পড়ালেখা করেছেন? কিভাবে এতসব বন্দনা শিখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিতেন খুবই শান্তভাবে। বলতেন, বঙ্গীশ থের নামের একজন ভিক্ষু ছিলেন উনাদের গ্রামের বিহারে। ছোটবেলায় ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাড়ার আরও দু’একজন মিলে বিহারে যেতেন বুদ্ধকে ফুল-পানি তোলতে ও বন্দনা করতে। সেসময় বঙ্গীশ থের তাদেরকে নানাধরনের বন্দনা, সূত্র ও গাথা শেখাতেন। সেগুলোই তাঁর এখনও মনে আছে। আমাকে বলতেন ভালভাবে পড়ালেখা কর। পারালেখা না করলে বড় হওয়া যায় না। কিভাবে শ্রদ্ধেয় উপসংঘরাজ সুগতবংশ মহাথের দেশনা দিতেন, তিনি যে অনেক বই লিখেছেন সেসব আমাকে তিনি বলতেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর এমনতর আগ্রহ দেখে আমি স্বতঃই অবাক হতাম।

প্রায়শই বিহারে আসলে জিজ্ঞেস করতেন আমার কিছু লাগবে কিনা। জিজ্ঞেস করতেন, সকালে কি খেয়েছি, দুপুরে কলেজে যাব কিনা ইত্যাদি। ভোরে যখন আসতেন বাড়ীতে পিঠা-পুলি যা কিছুই তৈরী হোক না কেন – হাতে করে দু’একটা নিয়ে আসতেন আমার জন্য। এখনও সেসব স্মৃতি মনে পড়লে চোখ জলভর্তি হয়ে উঠে। স্বার্থ-অন্বেষী এ পৃথিবীতে যখন দেখি চারিদিকে শুধু ঈর্ষা-হানাহানি, মিথ্যা ও শঠতার বড়াই, তখন বুড়িভাইয়ের স্নেহজরিত উপদেশাবানীর কথা বারবার মনে পড়ে। ২০০২ সালে ডক্টর জিনবোধি মহাথেরের উপাধ্যায়ত্বে যখন আমি উপসম্পদা গ্রহন করি পাহাড়তলীর মহানন্দ সঙ্ঘরাজ বিহারের ভিক্ষুসীমায়, আমার উপসম্পদা-দায়িকা বা ধর্মমাতা হন বুড়িভাই। তাঁর দানকৃত চীবর, ও ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে বুদ্ধশাসনে ধর্মশিক্ষা ও ধর্মদানে ব্রত থেকে জীবনোৎসর্গ করার ব্রত গ্রহন করি। তাই আমার ভিক্ষু জীবনের অর্জিত সমস্থ পুন্যরাশি আমি প্রতিনিয়ত তাঁহার উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করি।

কিছু কিছু মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকেন তাঁদের অমায়িক আচার-ব্যাবহারের জন্য, তাদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্য, তাদের অতিসাধারন ও নিরাসক্ত জীবনের জন্য। স্নেহলতা বড়ুয়া বা বুড়িভাই সেরকমই একজন মানুষ। পৃথিবীতে যে কয়জন ভাল মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, বুড়িভাই তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি যতদিন বেঁচে থাকব তাঁর স্মৃতি আমার অন্তরে আম্লান থাকবে। তাঁর উন্মুক্ত মানসিকতা, শান্ত-শিষ্ট অবয়ব, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং সর্বোপরি স্নেহপরায়নতা ও মমত্ববোধ সবসময় আমাকে অনুপ্রাণিত করবে। বুড়িভাই যেখানেই জন্ম নিয়ে থাকুক না কেন আমার বিশ্বাস উনি সুখে এবং শান্তিতে আছেন, কেননা সারাজীবন তিনি দেশের ও দশের মঙ্গল কামনাই করেছেন।

পালিসাহিত্যের ধর্মপদের একটি গাথা বুড়িভাইয়ের ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। সেটা হচ্ছে –

ইধ নন্দতি, পেচ্চ নন্দতি, কতপুঞঞো উভয়ত্ত নন্দতি;

পুঞঞং মে কতন্তি নন্দতি, ভিয়্যো নন্দতি সুগগতিং গতো। (ধম্মপদ, ১৮)

অর্থাৎঃ কৃতপুন্য ব্যাক্তি ইহলোক ও পরলোক উভয়ত্রই আনন্দিত হন। আমার দ্বারা পুন্য করা হইয়াছে, ইহা স্মরন করিয়া তিনি আনন্দিত হন এবং সুগতি প্রাপ্ত হইয়া তিনি পরমানন্দ লাভ করেন। (ধর্মাধার ভান্তে কতৃক অনুবাদিত)

আমার দৃঢ় বিশ্বাস বুড়িভাই সুগতি প্রাপ্ত হয়েছেন এবং ইহলোকে কৃত পুন্যের কারনে পরলোকেও তিনি পরমানন্দেই আছেন।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s