থাইল্যান্ডে প্রবারণার অভিজ্ঞতা

ভিক্ষু জ্ঞানবোধি

আষাঢ়ী পূর্নিমা থেকে আশ্বিনী পূর্নিমা পর্যন্ত সুদীর্ঘ তিন মাস বর্ষাব্রত শেষে এই পবিত্র প্রবারণা পূর্নিমানুষ্ঠান আসে। সকল থেরবাদ বৌদ্ধ দেশে অনুষ্ঠানটি প্রায় একযোগেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে প্রবারণা হয় একদিনের ব্যবধানে। বাংলাদেশে একদিন আগে হয় আর থাইল্যান্ডে হয় একদিন পরে। যদিও উভয় দেশে অনুষ্ঠানের কার্যক্রমের বিভিন্নতা দেখা যায়, মূল আদর্শ বা উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন।

প্রবারণার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে এইদিন বর্ষাব্রতী সকল ভিক্ষুসংঘকে বিহারের দায়ক-দায়িকাগণ পুঁজো ও সম্মান জানাবেন। কেননা তাদের বিহারে অবস্থানরত সমস্থ ভিক্ষুসংঘ গত তিনমাস পর্যন্ত বিনয়ানুসরনের মাধ্যমে ধর্মচর্চা করেছেন। তারা আধ্যাত্মিক সাধনার অনুশীলন করেছেন। এখন তারা আবার বের হবেন ধর্ম প্রচারার্থে বিভিন্ন জনসমাগমে। বর্তমানে এর ব্যবহারিক সত্যতা যাই হোক না কেন, বৌদ্ধ বিনয়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুসারে এঠাই হচ্ছে ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সকল থেরবাদ বৌদ্ধ দেশে বর্ষা-যাপন, প্রবারণা উদযাপন ও কঠিন চীবর দানোৎসব হয়ে থাকে।

দেখা যাক থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠানটি কিভাবে হয়। প্রবারণার আগের দিন বিকাল থেকে মাইকে ধর্মীয় সিডি বা ক্যাসেট চালানো হয়। পরদিনের অনুষ্ঠান এবং তার গুরত্ব সম্পর্কে ঘোষনা করা হয়। সকল ভিক্ষু সংঘ সেদিন মস্তক মুন্ডন করে ফেলে। পরদিন সকালে যথারীতি পিন্ডপাত বা ভিক্ষান্ন সংগ্রহ শেষে সকল ভিক্ষু ও শ্রমণ সংঘকে উপস্থিত হতে হবে দান-শালায়। সেখানে ততক্ষণে অনেক উপাসক-উপাসিকা এসে পড়েছেন। এবং তারা ভিক্ষুসংঘের জন্য প্রাতরাশ তৈরী করছেন. ভিক্ষু ও শ্রমণ সংঘ সারিবদ্ধ হয়ে দান-শালায় প্রবেশ করেন এবং নিজেদের আসন গ্রহণ করেন। এর পর উপস্থিত গৃহীসংঘ বুদ্ধকে বন্দনান্তে সংঘকে বন্দনা নিবেদনের মাধ্যমে আহার উত্সর্গ করেন। ভিক্ষুসংঘও বুদ্ধকে বন্দনা নিবেদনের মাধ্যমে সুত্রপাঠ করেন সকলের মঙ্গলের অন্য. এর পর সংঘ যখন তাদের প্রাতরাশ গ্রহণ করেন ঠিক একই সময়ে একজন ভিক্ষু শীলাদি ধর্মদেশনা প্রদান করেন গৃহীসংঘকে। প্রাতরাশ শেষে ভিক্ষু-শ্রমণ সংঘ ধর্য্যসহকারে অপেক্ষা করেন ধর্মদেশক ভিক্ষুর জন্য। ঐ ভিক্ষুটির ধর্ম-দেশনা শেষে গৃহী-সংঘ আবার বুদ্ধ-সহ ভিক্ষু-শ্রমণ সংঘকে শ্রদ্ধা ও বন্দনা নিবেদন করেন। এদিকে ভিক্ষু সংঘও বুদ্ধ বন্দনা শেষে আশির্বাদ দেন গৃহিদেরকে। এরপর সারিবদ্ধ হয়ে দানশালা হতে প্রস্থান করেন। একটি কথা এখানে উলেখ করা প্রয়োজন যে থাইল্যান্ডের প্রতিটি বিহারে ৫০-৬০ জনের মত ভিক্ষু সংঘ থাকেন। সুতরাং বিহারের সব ধর্মীয় আয়োজন খুব সমারোহের সাথে সম্পাদিত হয়।

গৃহী-সংঘ সেদিন পুরোটা দিন কাটায় বিহারে নানারকম ধর্মীয় চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে। বিকাল সাড়ে তিনটায় সকল ভিক্ষু-সংঘ সীমাঘরে উপস্থিত হয়ে বুদ্ধ বন্দনা ও ভিক্ষুদের আপত্তি দেশনাদি সম্পাদন করেন। এরপর ভিক্ষুদের বর্ষাবাস অনুসারে ক্রমান্বয়ে একে একে প্রবারণা গাথা আবৃত্তি করেন-‘সংঘং ভন্তে, পবারেমি, দিট্ঠেন বা সুতেন বা পরিসংখায় বা বদন্তু মং আয়স্মন্তু অনুকম্পং উপাদায়, পস্সন্ত পটিক্করিস্সামি’। এদিকে গৃহী-সংঘকে কোনো এক ভিক্ষু কর্তৃক বৈকালিক ধর্ম দেশনা দেওয়া হয়। উল্লেক্ষ্য যে এদেশে ফানুস উত্তোলনের তেমন বিশেষ কোনো প্রথা নেই। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় বাংলাদেশী ভিক্ষু-সংঘগণ এসময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময় ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে ফানুস উত্তোলন করে থাকেন। কিন্তু এখানে প্রবারণার শেষ নয়। পরদিন সকালে প্রত্যেক বিহারে গণপিন্ডপাতের আয়োজন করা হয়। বিহারের সমস্থ ভিক্ষু সংঘ সারিবদ্ধ হয়ে পিন্ডপাত করেন এসময়। দাযকগণ পিন্ডপাত শুরু হওয়ার পূর্বে বুদ্ধ বন্দনা ও পঞ্চশীল গ্রহণ করেন এবং ভিক্ষু গণ তাদেরকে ‘অভিবাদেন সীলস্স…’ বলে আশির্বাদ প্রদান করেন। এভাবে থাইল্যান্ডে প্রবারণা অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়ে থাকে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s