কোসম্বিয়সুত্ত: বা বিবাদ মুক্তির উপায়!

তথাগত বুদ্ধ তখন কৌশম্বীর ঘোসিতারামে অবস্থান করছিলেন। একসময় তথায় অবস্থানরত ভিক্ষুদের দুই দলের মধ্যে এক কঠিন বিবাদের সৃষ্টি হয়। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে ধারালো বাক্যের ছুরি ছুঁড়তে থাকে। কেউ কাউকে রাজি নয়। এমন সময় জনৈক ভিক্ষু বুদ্ধের কাছে গিয়ে ব্যাপারটি বুদ্ধকে অবহিত করে। বুদ্ধ বিবাদ-রত ভিক্ষুদেরকে তাঁর কাছে ডেকে আনবার জন্য আদেশ দেন। তাঁরা আসলে বুদ্ধ ঘটনার সত্যতা যাচাই করে তাদেরকে বলেন; নির্বোধ, সহব্রহ্মচারীদের ভিতর এরূপ ঝগড়া-বিবাদ ও বাদানুবাদের মধ্যে কোনও প্রকার মৈত্রীর প্রকাশ পায় না। এটা সবার জন্যই ক্ষতিকর এবং দুঃখপূর্ণ।

তারপর বুদ্ধ বলেন যে ছয়টি বিষয় আছে যেগুলো প্রত্যেকের স্মরণ রাখা কর্তব্য কেননা সেগুলোর চর্চায় প্রীতিভাব,  ঐক্য, শান্তি, সম্মান, সাম্যভাব, এবং সামগ্রিকতার বৃদ্ধি হয়। সে ছয়টি বিষয় হল:

১) কায়িকভাবে প্রকাশ্যে কিম্বা গোপনে সহব্রহ্মচারীদের প্রতি মৈত্রীর চর্চা করা,

২) বাচনিকভাবে মৈত্রী চর্চা করা,

৩) মানসিকভাবে মৈত্রী চর্চা করা,

৪) নিজের সদ্ধর্ম প্রতিপালনে লব্ধ বস্তুসমূহ (এমনকি নিজ পাত্রের আহারপর্যন্ত) কোনোপ্রকার আপত্তিকর মনোভাব ছাড়া সহব্রহ্মচারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা।

৫) প্রকাশ্যে এবং গোপনে অখণ্ডিত, অছিদ্র, নিষ্কলঙ্ক, বিমুক্তিপ্রদায়ী, বিজ্ঞদের প্রশংসিত, অনিস্প্রভ, সমাধিস্থাপক, শীলপালনে সব্রহ্মচারীদের সাথে বাস করা।

৬) সব্রহ্মচারীদের সঙ্গে আর্য্য ও বিমুক্ত চিন্তা-ধারার সাথে বসবাস করা উচিত যেটা দুঃখের পরিসমাপ্তি সদনে সহায়ক।

একটি দালানের সর্বোচ্চশিখড়ের মত এই ছয়টি বিষয়ের মধ্যে শেষেরটিই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তারপর বুদ্ধ বর্ণনা করেন কিভাবে এই আর্য্য ও বিমুক্ত দৃষ্টির মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে দুঃখক্ষয় করা সম্ভব।

একজন ভিক্ষু অরণ্যে, রুক্ষমূলে, কিংবা শুন্যাগারে ভাবনানুশীলন করতে গিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে – তাঁর মধ্যে অপরিত্যাক্ত কোনো আসক্তি কিংবা দুর্বলতা আছে কিনা যা তার বিমুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যদি সে দেখতে পায় যে তার মধ্যে কামতৃষ্ণা, হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা (পালি:-ব্যাপাদ), অলসতা ও নিস্ক্রীয়ভাব (পালি:-থীনমিদ্ধ), অস্থিরতা বা ঔদ্ধত্যভাব, সংশয় বা বিচিকিৎসা (পালি:-বিচিকিচ্ছা) বিদ্যমান এবং সে ইহলোক বা পরলোকের চিন্তায় সদামগ্ন, সহব্রহ্মচারীদের সঙ্গে বিবাদপরায়ণ তাহলে বুঝতে হবে তাঁর মন আসক্তি-পরিব্যাপ্ত। মন এরূপ অপরিত্যাক্ত আসক্তি ও দুর্বলতায় পরিব্যাপ্ত থাকার কারণে সে চতুরার্য্য সত্য সম্পর্কে যথাভূত জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এই বোধ থেকে তাঁর প্রথম জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এর দ্বারা লব্ধ অন্তরের প্রশান্তিকে বুঝতে পারা হচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় জ্ঞান। বুদ্ধের শিক্ষার বাইরে অন্য কেউ এরূপ শিক্ষা দেয না জানাই হচ্ছে তাঁর তৃতীয় জ্ঞান। নিজের মধ্যে সম্যক দৃষ্টি আছে কিনা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে তাঁর কৃত বিন্দুমাত্র অপরাধেরও প্রকাশ এবং সেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য সংযমতা অবলম্বণ হচ্ছে তাঁর চতুর্থ জ্ঞান। সম্যকদৃষ্টি প্রতিপন্ন হয়ে সহব্রহ্মমচারীদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মব্যাস্ততার পরও অধিশীল বা উন্নততর শীল, অধিচিত্ত, এবং অধিপ্রজ্ঞা বৃদ্ধির জন্য সচেতন হওয়া হচ্ছে তাঁর পঞ্চম জ্ঞান। সদ্ধর্মশ্রবণে পূর্ণমনযোগ এবং উৎসাহ বা শক্তি স্থাপন করা হচ্ছে তাঁর ষষ্ট জ্ঞান। এবং সদ্ধর্ম দেশনায় তার অর্থবোধ, ধর্মবোধ, এবং ধর্মে প্রমোদ লাভ করাটাই তাঁর সপ্তম জ্ঞান।

এই সপ্ত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে সে স্রোতাপত্তিফল লাভ করতে সক্ষম হয়।

(মধ্যম নিকায়, কোসম্বিয় সুত্র)

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s