একসময় ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্থীর জেতবনে অনাথপিন্ডিকের আরামে অবস্থান করছিলেন। সেসময় আয়ুস্মান গিরিমানন্দ অত্যদিক অসুস্থ, পীড়িত ও রোগগ্রস্থ হয়ে পরেন। অতপর আয়ুস্মান আনন্দ ভগবাণের নিকট উপস্থিত হন। ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক একপাশে বসে তিনি এরূপ বলেনঃ
ভন্তে ভগবান আয়ুস্মান গিরিমানন্দ অত্যদিক অসুস্থ, পীড়িত ও রোগগ্রস্থ। অনুকম্পাপূর্বক আয়ুস্মান গিরিমানন্দকে দেখতে গেলে ভাল হয়।
আনন্দ, তুমি যদি আয়ুস্মান গিরিমানন্দের নিকট গিয়ে তাকে দশ প্রকার সংজ্ঞা সম্পর্কে দেশনা কর, তা শুনে তার রোগ ব্যাধি উপশম হতে পারে। সেই দশ প্রকার সংজ্ঞা কি? অনিত্য সংজ্ঞা, অনাত্ম সংজ্ঞা, অশুভ সংজ্ঞা, আদীনব সংজ্ঞা, প্রহান সংজ্ঞা, বিরাগ সংজ্ঞা, নিরোধ সংজ্ঞা, সর্বলোকে অনভিরতি সংজ্ঞা, সর্ব সংস্কারে অনিত্য সংজ্ঞা, এবং আনাপানাস্মৃতি সংজ্ঞা।
আনন্দ, অনিত্য সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু অরন্যে, রুক্ষমূলে বা শুন্যাগারে গিয়ে এরূপ চিন্তা করেন যে – রূপ অনিত্য, বেদনা অনিত্য, সংজ্ঞা অনিত্য, সংস্কার অনিত্য, ও বিজ্ঞান অনিত্য। সে এ পঞ্চউপাদানস্খন্ধে অনিত্যদর্শী হয়ে অবস্থান করে। আনন্দ, এটিই হচ্ছে অনিত্য সংজ্ঞা।
আনন্দ, অনাত্ম সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু অরন্যে, রুক্ষমূলে বা শুন্যাগারে গিয়ে এরূপ চিন্তা করেন যে – চক্ষু অনাত্ম, রূপ অনাত্ম, শ্রোত্র অনাত্ম, শব্দ অনাত্ম, ঘ্রান অনাত্ম, গন্ধ অনাত্ম, জিহ্বা অনাত্ম, রস অনাত্ম, কায় অনাত্ম, স্পর্শ অনাত্ম, মন অনাত্ম, ও ধর্ম (চিন্তাসমুহ) অনাত্ম। সে এ ছয় আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক আয়তনে অনাত্মদর্শী হয়ে অবস্থান করে। আনন্দ, এটিই হচ্ছে অনাত্ম সংজ্ঞা।
আনন্দ, অশুভ সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোনভিক্ষু পাদতল হতে উর্ধে এবং মস্তকের কেশ হতে নিন্মে কেশাবৃত এ শরীরের পুরোটায় বিভিন্ন প্রকারের অশুচি পদার্থ এভাবে পর্যবেক্ষন করেন যে – এ দেহে কেশ, লোম, নখ, দাঁত, ত্বক, মাংশ, পেশীতন্তু , অস্থি, অস্থিমজ্জা, বৃক্ক, হৃদয়, যকৃত, ক্লোম, প্লীহা, ফুসফুস, অন্ত্র, অন্ত্রগুণ, উদর, মল, মস্তিস্ক, পিত্ত, শ্লেস্মা, পুঁজ, রক্ত, স্বেদ, মেদ, অশ্রু, চর্বি, তুতু, সিকনি, লাসিকা ও মুত্র বিদ্যমান। সে এভাবে শরীরে অশুভদর্শী হয়ে অবস্থান করে। আনন্দ, এটিই হচ্ছে অশুভ সংজ্ঞা।
আনন্দ, আদীনব সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু অরন্যে, রুক্ষমূলে বা শুন্যাগারে গিয়ে এরূপ চিন্তা করেন যে –এ শরীর বহু দুঃখ ও আদীনব (দোষ) পুর্ন। এ শরীরে বিবিধ প্রকার রোগ উৎপন্ন হয়। যেমন – চক্ষু রোগ, শ্রোত্র রোগ, ঘ্রান রোগ, জিহ্বা রোগ, কায় রোগ, শির রোগ, কর্ন রোগ, মুখের রোগ, দন্ত রোগ, ওষ্ঠ রোগ, শ্বাস রোগ, হাঁপানি, সবর্দি, দাহ, জ্বর, পেটের ব্যাথা, মূর্চ্ছা, আমাশয়, সূল, কলেরা, কুষ্ঠরোগ, গন্ড বা ফোঁড়া, কণ্ডূ, যক্ষা, মৃগীরোগ, চর্মরোগ, চুলকানি, পাণ্ডুরোগ, বহুমুত্র, অর্শ্ব, ভগন্দর, পিত্তরোগ, শ্লেস্মাজনিত রোগ, বাতব্যাধি, বায়ুরোগ, কায়রসজাত রোগ, সংক্রামক রোগ, ঋতুপরিবর্তনজাত রোগ, অপর্যাপ্ত শারীরিক যত্নহেতু রোগ, কর্মবিপাকজ রোগ, শীত, উষ্ণ, খুধা, পিপাসা, মল, মুত্র ইত্যাদি। সে এভাবে শরীরে আদীনবদর্শী হয়ে অবস্থান করে। আনন্দ, এটিই হচ্ছে আদীনব সংজ্ঞা।
আনন্দ, প্রহান সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু উৎপন্ন কামবিতর্ক সহ্য করে না। সে তা বর্জন করে, দমন করে, অন্তসাধন করে ও অস্থিত্ব বিনাশ করে। সে উৎপন্ন ব্যাপাদ সহ্য করে না। বরং তা সে বর্জন করে, দমন করে, অন্তসাধন করে ও অস্থিত্ব বিনাশ করে। সে উৎপন্ন বিহিংসাবিতর্ক সহ্য করে না। বরং সে তা বর্জন করে, দমন করে, অন্তসাধন করে ও অস্থিত্ব বিনাশ করে। সে উৎপন্ন-অনুতপন্ন পাপ ও অকুশল ধর্ম সহ্য করে না। বরং তা সে বর্জন করে, দমন করে, অন্তসাধন করে ও অস্থিত্ব বিনাশ করে। আনন্দ, এটিই হচ্ছে তার প্রহান সংজ্ঞা।
আনন্দ, বিরাগ সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু অরন্যে, রুক্ষমূলে বা শুন্যাগারে গিয়ে এরূপ চিন্তা করেন যে – ইহা শান্ত, ইহা প্রনীত, ইহা সর্বসংস্কারের উপশম, সর্বউপাদি হতে মুক্ত, তৃষ্ণাক্ষয়, বিরাগ, ও নির্বান। আনন্দ, এটিই হচ্ছে তার বিরাগ সংজ্ঞা।
আনন্দ, নিরোধ সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু অরন্যে, রুক্ষমূলে বা শুন্যাগারে গিয়ে এরূপ চিন্তা করেন যে – ইহা শান্ত, ইহা প্রনীত, ইহা সর্বসংস্কারের উপশম, সর্বউপাদি হতে মুক্ত, তৃষ্ণাক্ষয়, বিরাগ, ও নির্বান। আনন্দ, এটিই হচ্ছে তার নিরোধ সংজ্ঞা।
আনন্দ, সর্বলোকে অনভিরতি সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু জগতে (ত্রিলোককে বোঝানো হচ্ছে) চিত্তের সমস্থ উপাদান বা আসক্তি, অধিষ্ঠান, অভিনিবেশ, অনুশয় পরিত্যাগপুর্বক উপাদি বা আসক্তিহীন হয়ে অবস্থান করে। আনন্দ, এটিই হচ্ছে তার সর্বলোকে অনভিরতি সংজ্ঞা।
আনন্দ, সর্ব সংস্কারে অনিত্য সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু সর্ব সংস্কারে বিরক্তবোধ করে, লজ্জাবোধ করে ও ঘৃনাবোধ করে। আনন্দ, এটিই হচ্ছে তার সর্ব সংস্কারে অনিত্য সংজ্ঞা।
আনন্দ, আনাপানাস্মৃতি সংজ্ঞা কি?
আনন্দ, এক্ষেত্রে কোন ভিক্ষু অরন্যে, রুক্ষমূলে বা শুন্যাগারে গিয়ে ঋজু কায়ে পদ্মাসনে বসে সম্মুখে স্মৃতি স্থাপন করে। স্মৃতিসহকারে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহন ও ত্যাগ করে। দীর্ঘশ্বাস গ্রহন করলে দীর্ঘশ্বাস গ্রহন করছি বলে জানে; দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করছি বলে জানে। হ্রস্বশ্বাস গ্রহন করলে হ্রস্বশ্বাস গ্রহন করছি বলে জানে; হ্রস্বশ্বাস ত্যাগ করলে হ্রস্বশ্বাস ত্যাগ করছি বলে জানে। সে শিক্ষা নেয় যে আমি সর্বকায় (দেহ) অনুভূত হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি সর্বকায় (দেহ) অনুভত হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি কায়সংস্কার উপশান্ত করে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি কায়সংস্কার উপশান্ত করে শ্বাস ত্যাগ করব।
সে শিক্ষা নেয় যে আমি প্রীতি সংবেদী হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি প্রীতি সংবেদী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি সুখ সংবেদী হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি সুখ সংবেদী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি চিত্তসংস্কার সংবেদী (জ্ঞাত) হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি চিত্তসংস্কার সংবেদী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি চিত্তসংস্কার উপশান্ত করে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি চিত্তসংস্কার উপশান্ত করে শ্বাস ত্যাগ করব।
সে শিক্ষা নেয় যে আমি চিত্তসংবেদী (জ্ঞাত) হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি চিত্তসংবেদী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি অতিশয় প্রমোদিত হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি অতিশয় প্রমোদিত হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি চিত্ত সমাধিস্থ করে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি চিত্ত সমাধিস্থ করে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি বিমোচিত চিত্তে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি বিমোচিত চিত্তে শ্বাস ত্যাগ করব।
সে শিক্ষা নেয় যে আমি অনিত্যানুদর্শী হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি অনিত্যানুদর্শী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি বিরাগানুদর্শী হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি বিরাগানুদর্শী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি নিরোধানুদর্শী হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি নিরোধানুদর্শী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আমি স্বত্বত্যাগানুদর্শী (পটিনিস্সগ্গ) হয়ে শ্বাস গ্রহণ করব; আমি স্বত্বত্যাগানুদর্শী হয়ে শ্বাস ত্যাগ করব। আনন্দ, এটিই হচ্ছে আনাপানাস্মৃতি সংজ্ঞা।
আনন্দ, তুমি যদি আয়ুস্মান গিরিমানন্দের নিকট গিয়ে তাকে দশ প্রকার সংজ্ঞা সম্পর্কে দেশনা কর, তা শুনে তার রোগ ব্যাধি উপশম হতে পারে।
অতপর আনন্দ ভগবানের নিকট এই দশপ্রকার সংজ্ঞা শিক্ষা করে আয়ুস্মান গিরিমানন্দের নিকট যায় এবং তার নিকটস্থ হয়ে তা পরিভাষণ করে। এবং আয়ুস্মান গিরিমানন্দ যখন তা শুনে তৎক্ষণাৎ তার রোগ উপশম হয় ও সে রোগ হতে অব্যাহতি লাভ করে। এভাবে আয়ুস্মান গিরিমানন্দ তার রোগ হতে মুক্তি লাভ করে।
গিরিমানন্দসুত্র সমাপ্ত।
অনুবাদঃ ভিক্ষু জ্ঞানবোধি