এ পৃথিবীতে কামভোগী বা সাধারন লোকজন, যারা গার্হস্ত্য জীবন যাপন করে, তাদের পক্ষে দারিদ্রতা অতীব দুঃখজনক (দালিদ্দিযং, ভিক্খবে, দুক্খং লোকস্মিং কামভোগিনো’তি)। একটি সুখী-সুন্দর জীবন যাপনের জন্য অন্ততঃপক্ষে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির পরিপূরণ খুবই প্রয়োজন। মৌলিক চাহিদা যেমনঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামে রত থেকে একটি শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করা কখনো সম্ভব নয়। তথাগত বুদ্ধ একদিকে যেমন বলেছেন অল্পেতে সন্তুষ্ঠ থাকতে (সন্তুটি্ঠ পরমং ধনং), অপরদিকে তিনি মানুষকে কর্মোদ্যোগী হতে আহবান জানিয়েছেন (ভোগা হোন্তি … উটঠানবীরিয়াধিগত)। যারা অভাবের তারনায় লিপ্ত এবং কর্মোদ্যোগী নয় তারা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য হয়তো ১) ঋন গ্রস্থ হয়ে দুঃখে পতিত হয়, অথবা ২) অনাচারে লিপ্ত হয়ে নিজের ও অন্যের দুঃখের কারণ হয়।
যেমন আমরা যদি সুত্রপিঠকের অঙ্গুত্তর নিকায়ের ঋনসুত্রের (৩য় খণ্ড, পৃ ৩৫১) দিকে আলোকপাত করি, তাহলে দেখতে পাই কিভাবে বুদ্ধ ঋনগ্রস্থ হওয়ার দুর্দশা সম্পর্কে বর্ননা করেছেন। তিনি সেখানে দু’ধরনের ঋনের কথা বলেছেনঃ ১)অর্থনৈতিক ঋন ও ২) আধ্যাত্মিক ঋন।
তিনি উক্ত সুত্রে বলেছেন যে দারিদ্রতাতো দুঃখজনক বটেই কিন্তু দারিদ্রের তারনায় ঋনগ্রস্থ হওয়া আরো বেশি দুঃখজনক। কেননা সে যদি সঠিক সময়ে ঋন পরিশোধ করতে না পারে তাহলে তাকে সুদ দিতে হবে। অধিক দেরিতে, সুদ বৃদ্ধি পাবে এবং ঋনদাতা কতৃক নানাভাবে লাঞ্চিত হবে। এভাবে সে ঋন নেওয়া, সুদ বৃদ্ধি পাওয়া, হেনস্থার শিকার হওয়া ইত্যাদি মিলে দুঃখের এক কঠিন ও কঠোর বন্ধনে পতিত হবে।
অনুরূপভাবে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় রত ভিক্ষুদের ক্ষেত্রেও বলেছেন কিভাবে তারাও ঋনগ্রস্থ হয় এবং দুঃখে পতিত হয়। যখন তারা কুশল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়, নৈতিক লজ্জা ও ভয় রহিত হয়, বীর্যহীন ও প্রজ্ঞাহীন হয়, কায়-বাক্য ও মনের দ্বারা দুশ্চরিত্র সম্পাদন করে – এটা হচ্ছে তাদের জন্য ঋন সদৃশ। এবং যখন সে তার এরূপ অকুশল ও অনৈতিক চিন্তা ও কর্ম বিজ্ঞজনের কাছ থেকে লুকানোর চেষ্ঠা করে – এটা হচ্ছে ঋনের সুদ সদৃশ। যখনতার দোষ-ত্রুটি বিজ্ঞ ভিক্ষুদের কর্তৃক দর্শিত হয় – তখন সেটা হচ্ছে উপহাস বা লাঞ্চিত হওয়ার ন্যায়। এবং সে যখন রুক্ষমূলে বা শূন্য আকাশের নিচে সাধনায় রত হয় তখন অকুশল কর্ম জনিত কারনে তার মনে গভীর অনুশোচনার সৃষ্টি হয় এবং সাধনায় অগ্রসরে হতে পারে না। এভাবে সে ইহলোকে যেমন আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি লাভ করতে পারে না, মৃত্যুর পরেও নিরয়ে বা তির্য্যকযোনীতে উৎপন্ন হয়ে অপরিসীম দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে।
দারিদ্রতার তাড়নায় পীরিত হয়ে মানুষ যে শুধু ঋনগ্রস্থ হয় ও দুঃখভোগ করে তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে সে নানা ধরনের অনাচার ও পাপাচারে যুক্ত হয়ে পরে। এ বিষয়ে আমরা দেখতে পাই দীর্ঘনিকায়ের চক্রবর্তী সিংহনাদ সুত্রে (৩য় খণ্ড, পৃ ৫৮)। সেখানে বুদ্ধ ব্যাখ্যা করেছেন যে, দারিদ্রতার কারনে মানুষ চৌর্যবৃত্তে জড়িয়ে পরে, রাজা বা শাসক কর্তৃক ধৃত হলে শাস্তি পাওয়ার ভয়ে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে পরের গৃহ লুন্ঠন ও দ্রব্য অপহরণ করে। এভাবে তারা খুন রাহাজানি করতেও পিছপা হন না। তথাগত বুদ্ধ অতি সংক্ষেপে দারিদ্রতার ক্ষতিকারক দিক বর্ননা করতে গিয়ে বলেন যে –
“অধিক দারিদ্রতার কারনে চৌর্যবৃত্তি বাড়ে, চৌর্যবৃত্তির বৃদ্ধিতে মিথ্যা বলা, প্রাণহানি সহ নানা ধরনের সামাজিকি অশান্তি ও উৎশৃংখলতার সৃষ্টি হয়।”
মানুষের এই দারিদ্রতা তথা দুঃখ হতে মুক্তির জন্য বুদ্ধ বিভিন্ন সুত্রে অনেক উপদেশবানী প্রদান করেছেন। বুদ্ধ সবসময় মানুষকে সৎ ও কর্মোদ্যোগী হতে আহবান জানিয়েছেন। তার মতে একজন সৎ, ধর্মপ্রাণ ও কর্মোদ্যোগী ব্যাক্তি তাঁর কর্মদক্ষতার জোড়ে জীবনকে উন্নতি ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যারা দরিদ্র, অসৎ ও কর্মোদ্যোগী নয় তারা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নে অসমর্থ। এধরনের ব্যাক্তিকে বুদ্ধ অন্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অংগুত্তর নিকায়ের অন্ধ সুত্রে (খণ্ড ১ম, পৃ ১২৯) বলেছেন যে, মানুষকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ ১) অন্ধ ২) একচক্ষু সম্পন্ন ও ৩) দুই চক্ষু সম্পন্ন।
অন্ধ হচ্ছেন তারা যারা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নে অসমর্থ অন্যদিকে তেমন ধর্মজ্ঞানহীন ও কুশল-অকুশল বিচারে অসমর্থ। তারা ইহলোকে যেমন দুঃখগ্রস্থ হয়, পরলোকেও দুঃখে পতিত হয়।
একচক্ষু সম্পন্ন ব্যাক্তি হচ্ছেন যাঁরা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নে যদিও সমর্থ কিন্তু ধর্মজ্ঞানহীন বা নৈতিকতা বোধ যাদের নেই। তারা অর্থ উপার্জনের নিমিত্তে করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। ফলে অধিক অর্থ উপার্জন সত্ত্বেও দুস্কর্মের কারনে নানা রকমের দুঃখে পতিত হয়।
দুই চক্ষু সম্পন্ন ব্যাক্তি হচ্ছে যারা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনয়নেও সমর্থ এবং ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন। তারা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি উভয়ই রক্ষা করে। অর্থোপার্জনের নিমিত্তে তারা নীতিবোধ ত্যাগ করে না এবং শুধুমাত্র নীতিবোদের খাতিরেও ভিখারী হয়ে যায় না। কেননা একটা ছাড়া অপরটি রক্ষা করা কঠিন। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যারা তাঁদের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার প্রেক্ষিতে দান ধর্মাদি কুশল কর্ম সম্পাদনে বঞ্চিত। আবার এমনও লোক আছেন যাঁদের অর্থ থাকা সত্বেও নৈতিকতাবোধ ও ধর্মজ্ঞানের অভাবে কুকর্মে জড়িত এবং কুশলকর্ম হতে বঞ্চিত।
নিন্মলিখিত পদ্যে অতীব সুন্দরভাবে বুদ্ধের মনোভাব পরিস্পুটিত হয়েছে –
অন্ধ সে জন –
ভোগ সম্পদ ও পূন্যার্জন থেকে বঞ্চিত যে হন।
একচক্ষু সম্পন্ন তিনি –
কামভোগে রত থেকে, ধর্ম পূন্য রহিত হন যিনি।
উভয় চক্ষু সম্পন্ন, শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি সেজন –
যিনি পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান ও ন্যায়পরায়ন হয়ে
করে সদা ভোগ সম্পদ ও পূন্যের আহরণ।
তথাগত বুদ্ধ সবসময় দু’প্রকারের সুখের কথা বলে থাকেন-১) ইহলোকের সুখ ও ২) পরলোকের সুখ। ইহলোকের সুখ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সত্য ও ন্যায়ের পথে চলে অর্থোপার্জন ও তাহার সঠিক ব্যবহার। আর পরলোকের সুখ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ধর্ম-পূন্য সম্পাদন করা। অঙ্গুত্তর নিকায়ের দীর্ঘজানু সুত্রে (খণ্ড ৪র্থ, পৃ ২৮১) বুদ্ধ খুব সুন্দর করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।
উক্ত সুত্রানুসারে- একসময় দীর্ঘজানু নামক এক কোলিয় পুত্র বুদ্ধের নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমরা যারা কামভোগী ব্যাক্তি, সাধারণ জীবন যাপন করি আমাদেরকে ইহকাল ও পরকাল উভয়কালের সুখের জন্য কি করা প্রয়োজন। বুদ্ধ তদুত্তরে দীর্ঘজানুকে বলেছেন যে, চারটি বিষয় আছে যেগুলো ইহলোকের সুখের কারন আর চারটি বিষয় আছে যেগুলো পরলোকে সুখ আনায়ন করে।
সে বিষয়গুলো কি কি? যে চারটি বিষয় ইহলোকে সুখ আনায়ন করে সেগুলো হল- ১) উত্থানসম্পদ ২) সংরক্ষন সম্পদ ৩) কল্যানমিত্র ও ৪) সমজীবন (সমজীবিকা)।
উত্থানসম্পদ মানে হচ্ছে একজন ব্যাক্তি যখন কোন কাজ করে সেটা সে তার শতভাগ নিষ্টা ও দক্ষতার সাথে নিরলস হয়ে সম্পাদন করে থাকে। সে ব্যাক্তি হতে পারে একজন কৃষক, দিনমজুর, কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষক।
সংরক্ষন সম্পদ মানে হচ্ছে একজন ব্যাক্তি তার নির্দিষ্ট পেশায় অনেক পরিশ্রমের দ্বারা বাহুবলের মাধ্যমে বা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে অর্থ বা সম্পদ উপার্জন করে, তা সে ভাল ভাবে সংরক্ষন করে। যাতে তার উপার্জিত সম্পদ চুরি না যায়, অগ্নিদগ্ধ না হয়, বা অন্যকোন ভাবে নষ্ট না হয়।
কল্যানমিত্রতা মানে হচ্ছে সে এমন লোকের সাথে বন্ধুত্ত্ব করে যারা তার কল্যানকামী। তারা শ্রদ্ধা, শীল ও ত্যাগ সম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান এবং সর্বদা ধর্মীয় আলাপ আলোচনায় রত থাকে। তারা অসত্য, অসুন্দর ও অমঙ্গল কর্ম সম্পাদন থেকে দূরে থাকে।
সমজীবিকা মানে হচ্ছে সে তার অর্জিত অর্থ-সম্পদ বুঝে-শুনে খরচ করে। অর্থাৎ সে তার আয় বুঝেই ব্যয় করে। সে অতিরিক্ত উন্নত জীবনও যাপন করে না আবার অতিরিক্ত অনুন্নত জীবনও যাপন করে না। এভাবে এ চারধর্মের সঠিক অনুশীলনে সে ব্যাক্তি ইহকালে সুখী হয়।
অনুরূপভাবে পরজীবনে সুখ লাভের জন্য বুদ্ধ চারটি ধর্মের কথা বলেছেন। সেগুলো হল-১) শ্রদ্ধা-সম্পদ ২) শীল-সম্পদ ৩) ত্যাগ-সম্পদ ও ৪) প্রজ্ঞা-সম্পদ। অর্থাৎ সে ত্রিরত্ন যেমনঃ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘরত্নের প্রতি শ্রদ্ধাবান হন। পঞ্চশীলের সঠিক প্রতিপালন করেন। সময়ে সময়ে দান-ধর্মাদি কুশলকাজ সম্পাদন করেন এবং জীবনের সত্য ও স্বরূপ অনুধাবনের জন্য সাধনায় রত হন।
এভাবে উপরোক্ত ধর্মাদির সঠিক অনুশীলনে সে ইহলোকেই চার রকমের সুখ উপভোগ করেন।
১) আমার অর্থ-সম্পদ সৎ ও নিষ্ঠার সহিত উপার্জিত। এই ভেবে সে আত্থি-সুখ লাভ করেন।
২)এরূপে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ সে তার প্রয়োজনানুসারে, মনের সুখে খরচ করতে পারেন। এটা হচ্ছে ভোগ-সুখ।
৩)তাকে কারো কাছ থেকে কোনো ঋন নিতে হয়না। এটা হচ্ছে ঋন না নেয়া জনিত সুখ।এবং
৪)কেউ তাকে কোনোভাবে তার উপার্জন ও জীবনাচার সম্পর্কে দোষারোপ করতে পারে না। এটা হচ্ছে অনবদ্য বা অনিন্দনীয় সুখ।
এভাবে আমরা দেখি যে তথাগত বুদ্ধ উনার বিভিন্ন সুত্রে কিভাবে সৎ ও নিষ্ঠার সাথে অর্থোপার্জন করা যায় এবং কিভাবে তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ইহলোক ও পরলোকের সুখ নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। আমরা যদি বুদ্ধের এ শিক্ষাসমূহের সঠিক মুল্যায়ন করতে পারি আমাদের জীবন অবশ্যই সুখের ও সুন্দর হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পৃথিবীর কোনো মানুষ অভাবের তারনায় নিপিড়িত না হোক।