A journey towards peace and harmony:

(A Report of the Excursion after the Orientation Program for the new students at IBC Korat Campus 2010)

###################

On Sunday (11th July 2010), in a very beautiful refreshing morning all the students both new and old gathered together in the front gate of the IBC Korat Campus. Everyone is excited communicating with their new friends with a smiling face. It appeared to be a purely Buddhist environment, a beautiful happy moment, a moment that never be forgotten from the memory of each individual of the group. While everyone is busy talking to their friends someone almost suddenly announced that the bus has arrived. Today everyone will be going out to a trip that is inspiring, educational and refreshing. From tomorrow onwards classes will begin. The IBC Korat Campus opened its door to the learning mind by organizing this trip to several important places in Korat after two days of orientation programme. The ‘trip’ that I call ‘A journey towards peace and harmony’.

In previous two orientation days old students shared their knowledge and experiences of their life in IBC (Songkhla Campus) to their new friends. They discussed the significance of Buddha’s teachings in resolving the present day Global problems. They discussed the holistic nature of Buddhism that should be studied and practiced not for the sake of personal gain alone but with a holistic attitude. The new students agreed to their old colleagues and submitted themselves with their weakness while the old friends promised to extand their kind cooperation.

As usual everybody moved towards the bus and sat on seats of their liking. With a very moving Pali chanting in the bus our journey began to the sightseeing of the Korat Province. Headed by Ven. Zhen Chan, the director of student affairs, first of all we arrived at Phimai Historical Park. It was really an amazing visiting spot. A guide took us around it explaining the history, architectural style and significance of the park. We came to know that it was built around 11th – 12th century A.D., some years before Angkor Wat of Cambodia was built, during the reign of king Suriyavarman – a Khmer king. The architectural style and the images on lintels represent the Brahmanic influence, though it was mainly a centre for Mahayana Buddhism. Built of bricks and sandstone the Phimai Historical Park is 655 meters wide and 1,033 meters long in its rectangular shape. However, the place appeared to me as a Mandala of Esoteric Buddhism. Finally we had our lunch on the beautiful grassy ground of the Park.

Secondly we had been to the National Museum of Phimai. Situated in front of a big pond the Museum attracts the mind of visitors. The first image we came across upon entering into the museum was the sandstone statue of the last great Khmer king Jayavarman – a master piece of the museum collection. The museum, however, stores a rich quantity of arts and architectures of Dvaravati and Khmer styles. This includes the history of Phimai in 11th – 13th century A.D., development of communities in the lower Issan, image curved at sandstone showing the religious rites of the time, and the image of the Buddha sheltered by seven headed Naga, and Shiva – the god of destruction etc.

Thirdly we visited an outdoor museum called Ban-Prasat. In this place there are 3 pits that have been landscaped and open to the public. In the pits are seen some human skeletons which according to archeologists are around three thousand years old. This indicates that people lived in this place at a time prehistoric to the early history. And the pottery and bronze elements found along with those skeletons suggest a very early period in the history of human civilization which archeologists call beginning of the ‘bronze age’.

Fourthly we visited a place called Sai-ngam. In this place we encountered an unusual phenomenon that is we saw many banyan trees of which branches and leaves are inter-woven by nature with each other. They are considered the largest Banyan trees in Southeast Asia. The branches and leaves of the trees are indistinguishable from one another. Among them there is also a holy tree of 350 years old which is respected by all people. A beautiful expression shared by our beloved teacher Dr. Dhammanandi after visiting this place was – just as the trees in this place standing together dependently we humans are also no different. Understanding the nature of dependency, therefore, we have to recognize our states of affairs and work accordingly.

Finally we visited a very magnificent temple by the name ‘Wat Salaloy’. Every building in temple area was built with lots of arts and architectural beauty. The temple is said to have been awarded for their unique way of erecting those buildings.

By the end of the day after visiting all five places mentioned above we came back to the bus exhausted but with a rich knowledge regarding the history of Korat Province. An obvious phenomenon that I observed throughout the trip was all friends while visiting each place were eagerly trying to know about the place and sharing their knowledge with the nearest colleagues. Finally I would say trip is a very important part of our learning. In trips we learn together in a joyous environment. We can feel the spirit of ‘oneness in differences’ or rather ‘unity in diversity’. Throughout the trip refreshments were served by Ven. Bangladeshi Satyajit and Ven. Laos Sanchoy. And the entertainment part was taken care of by Mr. Thai Thammasak.

Ven. Zhen Chan thanking all the participants in the trip and reciting the ‘Namo Amitabha Sutra’ together concluded the journey. It was really a journey towards peace and harmony. It laid a lasting impression on my heart that I will never forget.

source: A journey towards peace and harmony:

At the Saint John Mary International School, Sara Buri

With Ven. Acharn Narong, it was wonderful to participate in a joint celebration of commencing the new academic year and mother’s day by the Saint John Mary International School at Sara Buri on Monday, August 10, 2015. We have been invited to share our understanding of ‘a mother’s spontaneous and unconditional love to her children and the importance of harmonious coexistence in the world’. At the end of sharing we have also conducted a short meditation session on ‘loving kindness’.

source: IBC bhikkhus went to share thoughts at an international school, Sara Buri

দারিদ্রতা বিমোচনে তথাগত বুদ্ধের শিক্ষা

এ পৃথিবীতে কামভোগী বা সাধারন লোকজন, যারা গার্হস্ত্য জীবন যাপন করে, তাদের পক্ষে দারিদ্রতা অতীব দুঃখজনক (দালিদ্দিযং, ভিক্খবে, দুক্খং লোকস্মিং কামভোগিনো’তি)। একটি সুখী-সুন্দর  জীবন যাপনের জন্য অন্ততঃপক্ষে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির পরিপূরণ খুবই প্রয়োজন। মৌলিক চাহিদা যেমনঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামে রত থেকে একটি শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করা কখনো সম্ভব নয়। তথাগত বুদ্ধ একদিকে যেমন বলেছেন অল্পেতে সন্তুষ্ঠ থাকতে (সন্তুটি্ঠ পরমং ধনং), অপরদিকে তিনি মানুষকে কর্মোদ্যোগী হতে আহবান জানিয়েছেন (ভোগা হোন্তি … উটঠানবীরিয়াধিগত)। যারা অভাবের তারনায় লিপ্ত এবং কর্মোদ্যোগী নয় তারা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য হয়তো ১) ঋন গ্রস্থ হয়ে দুঃখে পতিত হয়, অথবা ২) অনাচারে লিপ্ত হয়ে নিজের ও অন্যের দুঃখের কারণ হয়।

যেমন আমরা যদি সুত্রপিঠকের অঙ্গুত্তর নিকায়ের ঋনসুত্রের (৩য় খণ্ড, পৃ ৩৫১) দিকে আলোকপাত করি, তাহলে দেখতে পাই কিভাবে বুদ্ধ ঋনগ্রস্থ হওয়ার দুর্দশা সম্পর্কে বর্ননা করেছেন। তিনি সেখানে দু’ধরনের ঋনের কথা বলেছেনঃ ১)অর্থনৈতিক ঋন ও ২) আধ্যাত্মিক ঋন।

তিনি উক্ত সুত্রে বলেছেন যে দারিদ্রতাতো দুঃখজনক বটেই কিন্তু দারিদ্রের তারনায় ঋনগ্রস্থ হওয়া আরো বেশি দুঃখজনক। কেননা সে যদি সঠিক সময়ে ঋন পরিশোধ করতে না পারে তাহলে তাকে সুদ দিতে হবে। অধিক দেরিতে, সুদ বৃদ্ধি পাবে এবং ঋনদাতা কতৃক নানাভাবে লাঞ্চিত হবে। এভাবে সে ঋন নেওয়া, সুদ বৃদ্ধি পাওয়া, হেনস্থার শিকার হওয়া ইত্যাদি মিলে দুঃখের এক কঠিন ও কঠোর বন্ধনে পতিত হবে।

অনুরূপভাবে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় রত ভিক্ষুদের ক্ষেত্রেও বলেছেন কিভাবে তারাও ঋনগ্রস্থ হয় এবং দুঃখে পতিত হয়। যখন তারা কুশল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়, নৈতিক লজ্জা ও ভয় রহিত হয়, বীর্যহীন ও প্রজ্ঞাহীন হয়, কায়-বাক্য ও মনের দ্বারা দুশ্চরিত্র সম্পাদন করে – এটা হচ্ছে তাদের জন্য ঋন সদৃশ। এবং যখন সে তার এরূপ অকুশল ও অনৈতিক চিন্তা ও কর্ম বিজ্ঞজনের কাছ থেকে লুকানোর চেষ্ঠা করে – এটা হচ্ছে ঋনের সুদ সদৃশ। যখনতার দোষ-ত্রুটি বিজ্ঞ ভিক্ষুদের কর্তৃক দর্শিত হয় – তখন সেটা হচ্ছে উপহাস বা লাঞ্চিত হওয়ার ন্যায়। এবং সে যখন রুক্ষমূলে বা শূন্য আকাশের নিচে সাধনায় রত হয় তখন অকুশল কর্ম জনিত কারনে তার মনে গভীর অনুশোচনার সৃষ্টি হয় এবং সাধনায় অগ্রসরে হতে পারে না। এভাবে সে ইহলোকে যেমন আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি লাভ করতে পারে না, মৃত্যুর পরেও নিরয়ে বা তির্য্যকযোনীতে উৎপন্ন হয়ে অপরিসীম দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে থাকে।

দারিদ্রতার তাড়নায় পীরিত হয়ে মানুষ যে শুধু ঋনগ্রস্থ হয় ও দুঃখভোগ করে তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে সে নানা ধরনের অনাচার ও পাপাচারে যুক্ত হয়ে পরে। এ বিষয়ে আমরা দেখতে পাই দীর্ঘনিকায়ের চক্রবর্তী সিংহনাদ সুত্রে (৩য় খণ্ড, পৃ ৫৮)। সেখানে বুদ্ধ ব্যাখ্যা করেছেন যে, দারিদ্রতার কারনে মানুষ চৌর্যবৃত্তে জড়িয়ে পরে, রাজা বা শাসক কর্তৃক ধৃত হলে শাস্তি পাওয়ার ভয়ে সে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে পরের গৃহ লুন্ঠন ও দ্রব্য অপহরণ করে। এভাবে তারা খুন রাহাজানি করতেও পিছপা হন না। তথাগত বুদ্ধ অতি সংক্ষেপে দারিদ্রতার ক্ষতিকারক দিক বর্ননা করতে গিয়ে বলেন যে –

“অধিক দারিদ্রতার কারনে চৌর্যবৃত্তি বাড়ে, চৌর্যবৃত্তির বৃদ্ধিতে মিথ্যা বলা, প্রাণহানি সহ নানা ধরনের সামাজিকি অশান্তি ও উৎশৃংখলতার সৃষ্টি হয়।”

মানুষের এই দারিদ্রতা তথা দুঃখ হতে মুক্তির জন্য বুদ্ধ বিভিন্ন সুত্রে অনেক উপদেশবানী প্রদান করেছেন। বুদ্ধ সবসময় মানুষকে সৎ ও কর্মোদ্যোগী হতে আহবান জানিয়েছেন। তার মতে একজন সৎ, ধর্মপ্রাণ ও কর্মোদ্যোগী ব্যাক্তি তাঁর কর্মদক্ষতার জোড়ে জীবনকে উন্নতি ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যারা দরিদ্র, অসৎ ও কর্মোদ্যোগী নয় তারা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নে অসমর্থ। এধরনের ব্যাক্তিকে বুদ্ধ অন্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অংগুত্তর নিকায়ের অন্ধ সুত্রে (খণ্ড ১ম, পৃ ১২৯) বলেছেন যে, মানুষকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ ১) অন্ধ ২) একচক্ষু সম্পন্ন ও ৩) দুই চক্ষু  সম্পন্ন।

অন্ধ হচ্ছেন তারা যারা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নে অসমর্থ অন্যদিকে তেমন ধর্মজ্ঞানহীন ও কুশল-অকুশল বিচারে অসমর্থ। তারা ইহলোকে যেমন দুঃখগ্রস্থ হয়, পরলোকেও দুঃখে পতিত হয়।

একচক্ষু সম্পন্ন ব্যাক্তি হচ্ছেন যাঁরা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়নে যদিও সমর্থ কিন্তু ধর্মজ্ঞানহীন বা নৈতিকতা বোধ যাদের নেই। তারা অর্থ উপার্জনের নিমিত্তে করতে পারে না এমন কোন কাজ নেই। ফলে অধিক অর্থ উপার্জন সত্ত্বেও দুস্কর্মের কারনে নানা রকমের দুঃখে পতিত হয়।

দুই চক্ষু সম্পন্ন ব্যাক্তি হচ্ছে যারা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনয়নেও সমর্থ এবং ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন। তারা তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি উভয়ই রক্ষা করে। অর্থোপার্জনের নিমিত্তে তারা নীতিবোধ ত্যাগ করে না এবং শুধুমাত্র নীতিবোদের খাতিরেও  ভিখারী হয়ে যায় না। কেননা একটা ছাড়া অপরটি রক্ষা করা কঠিন। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যারা তাঁদের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার প্রেক্ষিতে দান ধর্মাদি কুশল কর্ম সম্পাদনে বঞ্চিত। আবার এমনও লোক আছেন যাঁদের অর্থ থাকা সত্বেও নৈতিকতাবোধ ও ধর্মজ্ঞানের অভাবে কুকর্মে জড়িত এবং কুশলকর্ম হতে বঞ্চিত।

নিন্মলিখিত পদ্যে অতীব সুন্দরভাবে বুদ্ধের মনোভাব পরিস্পুটিত হয়েছে –

অন্ধ সে জন –

ভোগ সম্পদ ও পূন্যার্জন থেকে বঞ্চিত যে হন।

একচক্ষু সম্পন্ন তিনি –

কামভোগে রত থেকে, ধর্ম পূন্য রহিত হন যিনি।

উভয় চক্ষু সম্পন্ন, শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি সেজন –

যিনি পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান ও ন্যায়পরায়ন হয়ে

করে সদা ভোগ সম্পদ ও পূন্যের আহরণ।

তথাগত বুদ্ধ সবসময় দু’প্রকারের সুখের কথা বলে থাকেন-১) ইহলোকের সুখ ও ২) পরলোকের সুখ। ইহলোকের সুখ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সত্য ও ন্যায়ের পথে চলে অর্থোপার্জন ও তাহার সঠিক ব্যবহার। আর পরলোকের সুখ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন ধর্ম-পূন্য সম্পাদন করা। অঙ্গুত্তর নিকায়ের দীর্ঘজানু সুত্রে (খণ্ড ৪র্থ, পৃ ২৮১) বুদ্ধ খুব সুন্দর  করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।

উক্ত সুত্রানুসারে- একসময় দীর্ঘজানু নামক এক কোলিয় পুত্র বুদ্ধের নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমরা যারা কামভোগী ব্যাক্তি, সাধারণ জীবন যাপন করি আমাদেরকে ইহকাল ও পরকাল উভয়কালের সুখের জন্য কি করা প্রয়োজন। বুদ্ধ তদুত্তরে দীর্ঘজানুকে বলেছেন যে, চারটি বিষয় আছে যেগুলো ইহলোকের সুখের কারন আর চারটি বিষয় আছে যেগুলো পরলোকে সুখ আনায়ন করে।

সে বিষয়গুলো কি কি? যে চারটি বিষয় ইহলোকে সুখ আনায়ন করে সেগুলো হল- ১) উত্থানসম্পদ ২) সংরক্ষন সম্পদ ৩) কল্যানমিত্র ও ৪) সমজীবন (সমজীবিকা)।

উত্থানসম্পদ মানে হচ্ছে একজন ব্যাক্তি যখন কোন কাজ করে সেটা সে তার শতভাগ নিষ্টা ও দক্ষতার সাথে নিরলস হয়ে সম্পাদন করে থাকে। সে ব্যাক্তি হতে পারে একজন কৃষক, দিনমজুর, কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষক।

সংরক্ষন সম্পদ মানে হচ্ছে একজন ব্যাক্তি তার নির্দিষ্ট পেশায় অনেক পরিশ্রমের দ্বারা বাহুবলের মাধ্যমে বা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে অর্থ বা সম্পদ উপার্জন করে, তা সে ভাল ভাবে সংরক্ষন করে। যাতে তার উপার্জিত সম্পদ চুরি না যায়, অগ্নিদগ্ধ না হয়, বা অন্যকোন ভাবে নষ্ট না হয়।

কল্যানমিত্রতা মানে হচ্ছে সে এমন লোকের সাথে বন্ধুত্ত্ব করে যারা তার কল্যানকামী। তারা শ্রদ্ধা, শীল ও ত্যাগ সম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান এবং সর্বদা ধর্মীয় আলাপ আলোচনায় রত থাকে। তারা অসত্য, অসুন্দর ও অমঙ্গল কর্ম সম্পাদন থেকে দূরে থাকে।

সমজীবিকা মানে হচ্ছে সে তার অর্জিত অর্থ-সম্পদ বুঝে-শুনে খরচ করে। অর্থাৎ সে তার আয় বুঝেই ব্যয় করে। সে অতিরিক্ত উন্নত জীবনও যাপন করে না আবার অতিরিক্ত অনুন্নত জীবনও যাপন করে না। এভাবে এ চারধর্মের সঠিক অনুশীলনে সে ব্যাক্তি ইহকালে সুখী হয়।

অনুরূপভাবে পরজীবনে সুখ লাভের জন্য বুদ্ধ চারটি ধর্মের কথা বলেছেন। সেগুলো হল-১) শ্রদ্ধা-সম্পদ ২) শীল-সম্পদ ৩) ত্যাগ-সম্পদ ও ৪) প্রজ্ঞা-সম্পদ। অর্থাৎ সে ত্রিরত্ন যেমনঃ বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘরত্নের প্রতি শ্রদ্ধাবান হন। পঞ্চশীলের সঠিক প্রতিপালন করেন। সময়ে সময়ে দান-ধর্মাদি কুশলকাজ সম্পাদন করেন এবং জীবনের সত্য ও স্বরূপ অনুধাবনের জন্য সাধনায় রত হন।

এভাবে উপরোক্ত ধর্মাদির সঠিক অনুশীলনে সে ইহলোকেই চার রকমের সুখ উপভোগ করেন।

১) আমার অর্থ-সম্পদ সৎ ও নিষ্ঠার সহিত উপার্জিত। এই ভেবে সে আত্থি-সুখ লাভ করেন।

২)এরূপে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ সে তার প্রয়োজনানুসারে, মনের সুখে খরচ করতে পারেন। এটা হচ্ছে ভোগ-সুখ।

৩)তাকে কারো কাছ থেকে কোনো ঋন নিতে হয়না। এটা হচ্ছে ঋন না নেয়া জনিত সুখ।এবং

৪)কেউ তাকে কোনোভাবে তার উপার্জন ও জীবনাচার সম্পর্কে দোষারোপ করতে পারে না। এটা হচ্ছে অনবদ্য বা অনিন্দনীয় সুখ।

এভাবে আমরা দেখি যে তথাগত বুদ্ধ উনার বিভিন্ন সুত্রে কিভাবে সৎ ও নিষ্ঠার সাথে অর্থোপার্জন করা যায় এবং কিভাবে তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ইহলোক ও পরলোকের সুখ নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন। আমরা যদি বুদ্ধের এ শিক্ষাসমূহের সঠিক মুল্যায়ন করতে পারি আমাদের জীবন অবশ্যই সুখের ও সুন্দর হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পৃথিবীর কোনো মানুষ অভাবের তারনায় নিপিড়িত না হোক।

৮ম সংঘরাজ শীলালঙ্কার মহাথের

সংঘরাজ নিকায়ের ৮ম সংঘনায়ক শ্রীমৎ শীলালঙ্কার মহাস্থবির চট্রগ্রামের ফটিকছড়ি থানার নানুপুর গ্রামে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আষার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জয়ধন বড়ুয়া এবং মাতার নাম শ্যামাবতী বড়ুয়া। তাঁর গৃহিনাম ছিল শ্রী সহদেব বড়ুয়া। তিনি শৈশবকাল হতে ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। শৈশবে তাঁর পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল ছিল। তিনি বাল্যকালে লেখাপড়া করার জন্য বেশ সুন্দর সুযোগও পেয়েছেন। গ্রাম্য স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়া শেষ করে তিনি চট্রগ্রাম শহরে জে, এম, সেন স্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে তিনি শ্রমণ পুন্নানন্দস্বামী লিখিত ‘রত্নমালা’ বই পরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তারপর থেকে তিনি প্রব্যজ্যা গ্রহণ করবার জন্য তাঁর অভিবাভকদের নিকট বেশ কয়েকবার আবেদন জানান। একসময় আকিয়াব জাতীয় বিহারের প্রধান অধ্যক্ষ অগ্গমহাপন্ডিত শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের সহিত তাঁর সাক্ষাত হয়। শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের সহিত সাক্ষাতের পর তিনি প্রব্যজ্যা গ্রহণ করবার জন্য আরো উদগ্রীব হয়ে পড়েন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অভিবাবকদের অজান্তে তিনি প্রব্যজ্যা গ্রহনের জন্য একাকী আকিয়াব যাত্রা করেন। কিন্তু এযাত্রা তাঁর ব্যর্থ হল।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে তিনি আবার আকিয়াব যাত্রা করেন। এই বৎসর ফেব্রুয়ারী মাসে শ্রী সহদেব বড়ুয়া আরকানী বিখ্যাত ভিক্ষু উ সুমঙ্গল স্থবিরের নিকট শ্রামন্য ধর্মে দীক্ষিত হন। তখন তাঁর নাম রাখায় হয় ‘শীলালঙ্কার’। তারপর তিনি শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের সহিত আকিয়াবে এক বনাশ্রমে ছয়মাস অতিবাহিত করে আকিয়াব শহরের জাতীয় বিহারে চলে আসেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আরকানের সোয়েজাদি (সুবর্ণ চৈত্য) বিহার সীমায় উ তেজরাম মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে ১৫ জন পঞ্চম সংগীতিকারক মহাস্থবিরের উপস্থিতিতে শ্রীমৎ শীলালঙ্কার এবং শ্রীমৎ ধর্মতিলক একই দিনে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। শ্রীমৎ শীলালঙ্কার ভিক্ষু শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরকে আচার্য্য হিসেবে গ্রহণ করেন। উপসম্পদা লাভের কিছুদিন পর তিনি তাঁর গুরু প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের সহিত চট্রগ্রামে আসেন। তাঁরা চট্রগ্রামে এসে মায়ানী বিহারে অবস্থান করেন। শ্রীমৎ শীলালঙ্কার ভিক্ষু মায়ানী বিহারে প্রথম বর্ষাবাস যাপন করেন। প্রথম বর্ষাবাসের পরে তিনি বিভিন্ন ধর্মসভায় শ্রীমৎ প্রজ্ঞাতিষ্য মহাস্থবির, জ্ঞানলঙ্কার মহাস্থবির, বঙ্গচন্দ্র মহাস্থবির, গিরীশচন্দ্র মহাস্থবির, বরজ্ঞান মহাস্থবির, বংশদ্বীপ মহাস্থবির, আর্য্যবংশ মহাস্থবির প্রভৃতি মহাপুরুষদের বৌদ্ধধর্ম বিনয় সম্বদ্ধে ভাষণ শুনে তিনি সদ্ধর্ম আয়ত্ত করবার জন্য বিশেষভাবে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমৎ শীলালঙ্কার ভিক্ষু, শ্রীমৎ ধর্মতিলক ভিক্ষু এবং শ্রীমৎ জ্যোতিপাল ভিক্ষুসহ শ্রীলংকায় যাত্রা করেন। সেখানে তাঁরা পানাদুরে সদ্ধর্মোদয় পরিবেনে বদ্ধ সীমায় শ্রদ্ধেয় উপসেন মহাস্থবিরের নিকট দ্বিতীয়বর কর্মবাক্য শ্রবণ করেন এবং তাঁর নিকট ধর্মবিনয় অধ্যয়ন করে সসেখানে দু’বৎসর অতিবাহত করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে তাঁরা কেন্ডির উভবর্ত নামক স্থানে সদ্ধার্মাবাস পরিবেনে শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ধর্মদর্শী মহাস্থবিরের নিকট আরো দু’বৎসর বৌদ্ধ ধর্ম বিনয় অধ্যয়অন করেন।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমৎ শীলালঙ্কার ভিক্ষু, রেঙ্গুনে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি কান্দগ্লে ধর্মদুত বিহারে তাঁর গুরুদেব শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের সহিত মিলিত হন এবং দু’মাস ধর্মদুত বিহারে অবস্থান করেন। তারপর তিনি চট্রগ্রামে এসে নানুপুরে দু’বছর অতিবাহিত করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমৎ শীলালঙ্কার মহাস্থবির কলকাতায় ধর্মাংকুর বিহারে, বিহারাধ্যক্ষ হয়ে আসেন। এসময়ে তিনি বৌদ্ধ বিষয়ক পুস্তক রচনা করতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমৎ শীলালঙ্কার মহাস্থবির শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবিরের আহ্বানে রেঙ্গুন যান। সেখানে তিনি “বৌদ্ধ মিশন”, বৌদ্ধ মিশন প্রেস এবং “সংঘ শক্তি” প্রভৃতির কার্যভার গ্রহণ করেন। দু’বছর এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। তারপর তিনি চট্রগ্রামে নানুপুর আনন্দধাম বিহারে অবস্থান করেন। ১৯৩৭ খ্রি: তিনি তৃতীয়বার রেঙ্গুন যাত্রা করেন। রেঙ্গুনে তিন বছর অবস্থান করে তিনি স্বদেশে আগমন করেন।

তারপর তিনি নানুপুরে ৫ বছর এবং হিঙ্গলে ৬ বছর অতিবাহিত করেন। ১৯৫২ খ্রি: তিনি বৈদ্যপাড়া শাক্যমুনি বিহারে আসেন এবং সেখানে ১৫ বছর অতিবাহিত করেন। ১৯৬৭ খ্রি: বৈদ্যপাড়া হতে বিদায় নিয়ে তিনি মির্জাপুর শান্তিধাম বিহারে বিহারাধ্যক্ষ হিসেবে আসেন। ১৯৭৫ খ্রি: সাতবাড়িয়া শান্তিধাম বিহারে পরম শ্রদ্ধেয় অভয়্তিশ্য মহাস্থবিরের শবদাহ ক্রিয়া সমাপ্ত হলে ২৭শে ফেব্রয়ারী তিনি সংঘরাজ নিকায়ে সংঘনায়ক পদে অভিষিক্ত হন।

শ্রদ্ধেয় সংঘরাজ শীলালঙ্কার মহাস্থবির বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বৌদ্ধ মিশন প্রেসে জরিত থেকে এবং “সংঘশক্তি পত্রিকায় সম্পাদনা করে অনেক বই প্রকাশ করেছেন”। ১৯৬৪ খ্রি: তিনি শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী স্থবিরের সহিত মিলিত হয়ে “ত্রিপিটক প্রচার বোর্ড” প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থাবলী: রাহুল চরিত, ধর্মপদার্থকথা (যমক বর্গের অনুবাদ), অজাতশত্রু, বিমানবত্থু, জীবক, বিশাখা, আনন্দ, বুদ্ধযুগে বৌদ্ধ নারী, বৌদ্ধ নীতি মঞ্জরী, জাতকাবলী ও বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের ক্রমবিকাশের ধারা ইত্যাদি।

দশম সংঘরাজ জ্যোতিপাল মহাথের

ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় কেমতলি গ্রাম. জনবহুল বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলাধীন লাকসাম থানার বরইগাঁও জনপদে একটি ছোট্র পল্লী. এই পবিত্র ভূমিতে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে বাবু চন্দ্রমণি সিংহ ও শ্রীমতি দ্রোপদীবালার কোলে ১৯১৪ সালে এক মহাপন্ডিতের ভূমিষ্ঠ হয়. কে জানত এই শিশু একদিন কেমতলি গ্রাম ছাড়িয়ে বাংলার বুকে একটি নিজস্ব স্থান গড়ে নিবে. কে জানত এই শিশু শুধু বরইগাঁও জনপদ নয় বরং গোটা বাংলার বৌদ্ধ তথা বঙ্গভূমির জন্য কল্যাণকারী মহামানবদের একজন হিসেবে স্থান গড়ে নিবে.

তাঁর গৃহী নাম দারিকা মোহন সিং. শিশুটি যখন ১২ বছরে পা দিল তাকে বুদ্ধ শাসনে প্রব্যজিত করা হয়. ক্রমে ২৪ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালের ১৪ই জুলাই উপসংঘরাজ পণ্ডিত শ্রীমত গুনালংকার মহাস্থবিরের উপাধ্যাযত্বে তিনি উপসম্পদা প্রাপ্ত হন. অতঃপর স্বনামধন্য পাহাড়তলী মহামুনি পালি কলেজে পণ্ডিত শ্রীমত ধর্মাধার মহাস্থবিরের তত্বাবধানে অধ্যবসায়ের সহিত পালি ভাষা, সাহিত্য ও বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেন. পরবর্তীতে কলকাতা ধার্মাংকুর বিদ্যাভবনে শ্রীমত বংশদ্বীপ মহাস্থবিরের নিকট পালি ভাষায় ধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন. এরপর বঙ্গীয় সংস্কৃতি পরিষদ হতে তিনি বিনয় ও অভিধর্ম বিভাগে উপাদি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণ পদক লাভ করেন. তিনি তাঁর জীবনে সাহিত্য চর্চাকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করতেন. তাঁরই ফলশ্রুতিতে তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন যেগুলো বাঙ্গালী বৌদ্ধসাহিত্যে তাঁর অমর সৃষ্ঠি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে. তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: ১) কর্মতত্ব, ২) পুদগল প্রজ্ঞপ্তি, ৩) মালয়েশিয়া ভ্রমণ কাহিনী, ৪) বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামে, ৫) বোধি চর্য্যাবতার, ৬) সাধনার অন্তরায়, ৭) বুদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা, ৮) সৌম্য সাম্যই শান্তির কারণ, ৯) প্রজ্ঞাভূমি নির্দেশ, ১০) ভারতে বৌদ্ধ, ১১) ব্রম্ম বিহার, ১২) চর্যাপদ, ১৩) বুদ্ধের জীবন ও বাণী, ১৪) গুরুদেব গুনালংকার মহাস্থবির, ও ১৫) রবীন্দ্র সাহিত্যে বৌদ্ধ সংস্কৃতি. তাঁর রচিত উক্ত গ্রন্থসমূহের মধ্যে চর্যাপদ চট্রগ্রাম বাংলা বিভাগে এবং পুদগল প্রজ্ঞপ্তি, বোধিচর্যাবতার এবং প্রজ্ঞাভূমি নির্দেশ চট্রগ্রাম পালি বিভাগে পাঠ্য পুস্থকের মর্যাদা লাভ করেছেন.

এছারাও তাঁর রচিত ধর্ম ও সমাজ সম্পর্কিত বহু প্রবন্ধ বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে. তিনি বোধিপত্র নামে এক ত্রৈমাসিক পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন. এতে তাঁর জ্ঞানের সুবিন্যস্থ প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়. সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি তাঁর জন্মস্থান বরইগাঁও-এ পালি পরিবেন, সমাজ কল্যাণ সংস্থা, অনাথ আশ্রম, পাবলিক লাইব্রেরী, উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, সমবায় সমিতি সহ অনেক সমাজ কল্যাণ মূলক কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন.

তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের কল্যানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন. এর একটি পরিপূর্ণ চিত্র তাঁর রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামে’ বইটিতে পাওয়া যায়. উক্ত গ্রন্থের পরিচিতিতে কথা সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, অধ্যাপক ডক্টর আবুল ফজল বলেন – “মহামানব গৌতম বুদ্ধের সাম্য-মৈত্রী-করুনা ও অহিংসার আদর্শে নিবেদিত প্রাণ গৈরিক বসনধারী এই বৌদ্ধ ভিক্ষু মুক্তিসংগ্রামকালীন কর্মতৎপরতা, বিশেষতঃ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে শুরু করে শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দক্ষিণপূর্ব এশীয় বৌদ্ধ প্রধান দেশগুলোতে ব্যাপক প্রচার ও তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জ্ঞাপন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্বজনমত প্রভূত সহায়তা করেছিল.”

শ্রীমত জ্যোতিপাল মহাথের তাঁর বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মকান্ডের জন্য অনেক পুরুস্কারে ভুষিত হন. তাঁর বিভিন্ন পুরুস্কারের মধ্যে – ১) ত্রিপিটক বিশারদ (গোল্ড মেডালিস্ট), ২) মহাধর্মনিধি, ৩) বিশ্বনাগরিক, ৪) ধর্ম ও শান্তি পুরুস্কার, ৫) অগ্রমহাসদ্ধর্মজ্যোতিকাধজ্বা, ৬) একুশে পদক, ৭) স্বাধীনতা পদক, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য.

২০০২ সালের ১২ই এপ্রিল এই মহান পুরুষ ইহধাম ত্যাগ করেন.

বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারী (ধর্মজ্ঞ সুত্রের আলোকে)

তথাগত বুদ্ধের ধর্ম হচ্ছে অমৃতপ্রদায়িনী। এধর্মের যথাযথ অনুশীলনে প্রত্যেকেই বিমুক্তিলাভে সমর্থ। যদিও সবার জন্য উন্মুক্ত, সম্বুদ্ধের এধর্ম সঠিকভাবে জানতে ও বুঝতে হলে একজন অভিজ্ঞ আচার্য বা শিক্ষকের সান্ন্যিধ্যের প্রয়োজন। কেননা বুদ্ধের ধর্ম অতীব সুক্ষ, গম্ভীর ও স্রোতের বিপরীতগামী। এ ধর্ম জ্ঞানীর ধর্ম। লোভ, দ্বেষ ও মোহে আচ্ছন্ন অশ্রুত, পৃথকজনের দ্বারা অধিগত করা সম্ভব নয়।

একজন অভিজ্ঞ আচার্য বা শিক্ষক হচ্ছেন তিনি যিনি ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত বুদ্ধের শিক্ষাসমূহকে যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছেন এবং তদনুসারে অনুশীলনে ব্রতী হয়ে নিজেকে আত্মশুদ্ধি ও আত্মমুক্তির পথে পরিচালিত করেছেন। এরূপ ভিক্ষুই হচ্ছে বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারী।

অঙ্গুত্তর নিকায়ের ধর্মজ্ঞ সূত্রানুসারে বুদ্ধধর্মের সঠিক অধ্যয়ন, অনুশীলন ও মানুষের মাঝে তা যথার্থরূপে প্রচারের জন্য একজন ভিক্ষুকে সাতটি গুনে গুণান্বিত হতে হবে। এ সপ্তগুন তাঁকে পঞ্চবিধ লাভ অর্জনে সহায়তা করে। কিন্তু এবম্বিধ সপ্তগুনে গুণান্বিত হতে হলে তাঁকে সুপ্রতিপন্ন, ঋজুমার্গ প্রতিপন্ন, ন্যায়প্রতিপন্ন ও সমীচীন প্রতিপন্ন হয়ে দৃঢ়তার সাথে বুদ্ধপ্রদর্শিত মার্গে অগ্রসর হতে হবে। নিন্মোক্ত ছকে উপরোল্লিখিত বিষয়সমূহ সুচারুরূপে তুলে ধরা হল।

abc

এ সপ্তগুনে গুণান্বিত ভিক্ষুই হচ্ছেন বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারী। কেননা তিনি স্বকীয় প্রচেষ্টায় বুদ্ধদেশিত ধর্ম অধিগত করেছেন এবং তাঁর অধিগত ধর্ম শুধুমাত্র নিজের মধ্যে ধরে না রেখে বিশ্বকল্যানে প্রচারে ব্রতী হয়েছেন। এখন দেখা যাক এ সপ্তগুন আসলে কি কি।

১) ধর্মজ্ঞঃ ধর্মজ্ঞ হওয়া মানে এককথায় ত্রিপিটকীয় গ্রন্থে রক্ষিত বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মবিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা। সূত্রানুসারে ধর্ম বলতে এখানে ‘নবঙ্গ সত্থুসাসন’ বা বুদ্ধের নয় প্রকার শিক্ষাকে বোঝানো হচ্ছে। যথাক্রমে – ১) সুত্র, ২) গেয়্য, ৩) ব্যাকরণ, ৪) গাথা, ৫) উদান, ৬) ইতিবুত্থক, ৭) জাতক, ৮) অদ্ভুদধর্ম, ও ৯) ভেদল্ল। অন্যকথায় বলতে গেলে গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে বুদ্ধ দেশিত সাঁইত্রিশ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্মে জ্ঞানার্জনকেই বলা হচ্ছে ধর্মজ্ঞ হওয়া।

২) অর্থজ্ঞঃ গ্রন্থে রক্ষিত শিক্ষাদি শুধুমাত্র তোতাপাখীর মতো মুখস্থ করে আওরালে চলবে না। এসবের যথাযথ অর্থও জানতে হবে। সঠিক ও যথার্থভাবে বুঝতে হবে কোন শিক্ষাটি লোকীয় অর্থপ্রদায়ক, কোনটি লোকুত্তর অর্থপ্রদায়ক, কোনটি নীত-অর্থবোধক কিংবা কোনটি নেঞঞ-অর্থবোধক ইত্যাদি। এভাবে সে তাঁর অনুসারীদের বলতে সক্ষম হবে যে – অয়ং ইমসস ভাসিতসস অত্থো – এটাই হচ্ছে এই বক্তব্যের যথাযথ অর্থ। অন্যতায় বুদ্ধ যেটা বলেছেন সেটা বলেননি বলে এবং যেটা বলেননি সেটা বলেছেন বলে প্রচার করলে, সে বুদ্ধের কথার অপব্যাখ্যার দোষে দোষী হবেন। সেজন্য বুদ্ধ মধ্যম নিকায়ের অলগর্দোপম সূত্রে তাঁর ধর্মের অধ্যয়নকারীদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তাঁর শিক্ষাসমূহ বিষাক্ত সাপের সাথে তুল্য। যদি কেউ সাপের লেজের দিকে ধরে তাহলে সেটা ঘুরে তাঁকে দংশন করবে। এবং সেই দংশনে সে হয়তো মারা যাবে অথবা মৃত্যুসম যন্ত্রনা অনুভব করবে। বুদ্ধের শিক্ষাও তদনুরূপ। ভুলভাবে কিংবা ভুল উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যাত হলে কারো মঙ্গল বয়ে আনবে না।

৩) আত্মজ্ঞঃ সেভিক্ষু শুধু ধর্মের অধ্যয়নে ও তাঁর অর্থ নিরূপণে থেমে থাকেন না। তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে নিজেকে বিচার করেন – তাঁর শ্রদ্ধা, শীল, শ্রুতি/শিক্ষা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও প্রতিভান কতটুকু উন্নত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, তথাগত বুদ্ধও বোধিলাভের পর বোধিবৃক্ষমূলে বসে বহুকষ্টে অধিগত তাঁর আত্মলব্ধ জ্ঞানের বিচার করেছিলেন। তাঁর মতে, “যতক্ষন পর্যন্ত আমি নিশ্চিত হইনি যে আমি সত্যিকার অর্থেই বুদ্ধজ্ঞান লাভ করেছি, আমি ধর্ম প্রচারে রত হইনি।

৪) মাত্রাজ্ঞঃ তিনি দায়ক-দায়িকাকতৃক দানকৃত চতুর্প্রত্যয় গ্রহনে মাত্রাজ্ঞ হন। নিজের পছন্দ ও অপছন্দের উপর ভিত্তি করে চতুর্প্রত্যয় গ্রহন ও বর্জন করেন না। স্বকীয় আধ্যাত্মসাধনা চালিয়ে নিতে যতটুকু প্রয়োজন তিনি শুধুমাত্র তততুকুই গ্রহন করেন। বুদ্ধ বলেছেন, “ভিক্ষুগন যখন যথালব্ধ চতুর্প্রত্যয়ে সন্তুষ্ট না থেকে ভাল ভাল চীবর, খাবার, শয্যাসন ও পথ্যাদির আশায় শহর নগরের দিকে ধাবিত হবেন তখন আমার শাসন অধঃপতনের দিকে এগুবে।”

৫) কালজ্ঞঃ কালজ্ঞ হওয়া মানে – তিনি একজন ভিক্ষু হিসেবে তাঁর দৈনন্দিন অবশ্যকরনীয় কর্তব্যের প্রতি সচেতন থাকেন। যেমনঃ কখন সূত্রাদি পাঠ করা উচিত; কখন ধর্মালোচনা করা উচিত; কখন ভাবনাবিরত হওয়া উচিত; কখন পিণ্ডচারনে যাওয়া উচিত ইত্যাদি।

৬) পরিষদজ্ঞঃ তিনি শুধুমাত্র ধর্মের অধ্যয়ন ও অনুশীলনে রত থাকেন না। তিনি জানেন যে বুদ্ধের এ শিক্ষা শুধুমাত্র আত্মোপলব্ধিতে সীমীত রাখার জন্য নয়, পরকল্যাণে প্রচারের জন্যও। তাইজন্য তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সম্পর্কে অবগত হন যে, এটা ক্ষত্রিয় পরিষদ, এটা ব্রাহ্মন পরিষদ, এটা গৃহপতি পরিষদ, এটা শ্রমণ পরিষদ ইত্যাদি। এবং এই বিভিন্ন পরিষদের মাঝে কিভাবে বা কখন উপস্থিত হওয়া উচিত; কিভাবে বা কোন বিষয়ে কথা বলা উচিত বা অনুচিত ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অবগত হন।

৭) অপরাপর পুদ্গলজ্ঞঃ তিনি শুধু বিভিন্ন পরিষদ সম্পর্কে জেনে ক্ষান্ত হন না, বরঞ্চ ধর্মশ্রবনে আগ্রহী ও অনাগ্রহী প্রতিটি ব্যাক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত হন। যেমন, কেউ আর্যদের দর্শনেচ্ছুক, কেউ দর্শনেচ্ছুক নয়। দর্শনেচ্ছুকদের মাঝে কেউ সদ্ধর্ম শ্রবনেচ্ছুক, কেউ নয়। সদ্ধর্ম শ্রবনেচ্ছুকদের মাঝে কেউ মনযোগী, কেউ নয়। মনযোগীদের মাঝে কেউ শ্রুতজ্ঞান অন্তরে ধারন করে, কেউ করে না। শ্রুতজ্ঞান অন্তরে ধারনকারীদের মাঝে কেউ তা স্বকীয় জ্ঞানে নিরীক্ষণ করে, কেউ করে না। কেউ নিরীক্ষিত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ধর্মানুরূপ আচরন করে, কেউ তা করে না। ধর্মানুরূপ আচরনকারীদের মাঝে কেউ আত্মহিত ও পরহিত উভয়হিতে নিজেকে নিয়োজিত করে, কেউ শুধুমাত্র আত্মহিতে প্রতিপন্ন, পরহিতে নয়। এভাবে সে ভিক্ষু লোকের বা পুদ্গলের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য জ্ঞাত হয়ে ধর্মদানে ব্রতী হন।

এ সপ্তগুনের অবিরত ও অবিশ্রান্ত অনুশীলন একদিকে যেমন একজন ভিক্ষুকে প্রকৃত বুদ্ধের অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলে, তেমনি অন্যদিকে তাঁকে একজন সুনিপুন শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করে। এবং এভাবে সে আজীবন নিজের ও অপরের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে।

*****************************

তথ্যসুত্রঃ

১) বড়ুয়া, শ্রী বেনীমাধব। (১৯৪০)। সুত্রপিটকে মধ্যম নিকায় (১ম খন্ড)। কোলকাতাঃ যোগেন্দ্র রূপসীবালা ত্রিপিটক বোর্ড।

২) বড়ুয়া, সুমঙ্গল। অঙ্গুত্তর নিকায় (৪র্থ খন্ডঃ ৭ম, ৮ম, ৯ম নিপাত)।

৩) মহাস্থবির, শান্তরক্ষিত। (১৯৭৫)। বুদ্ধের প্রধান প্রথম দুটি বানী। আন্দরকিল্লাঃ হাবিব প্রিন্টিং প্রেস।

৪) মহাস্থবির, ধর্মাধার। (১৯৯৫)। বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন। কোলকাতাঃ ধর্মাধার বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশনী।

—ভিক্ষু জ্ঞানবোধি

আমার স্মৃতিতে বুড়িভাই (স্নেহলতা বড়ুয়া)

ভিক্ষু জ্ঞানবোধি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন –

বিশ্বে যাকিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যানকর,

অর্ধেক তাঁর করিয়াছে নারী, অর্ধেক তাঁর নর। (সঞ্চয়িতা, ৭৪)

কিন্তু আমাদের এই পুরুষপ্রধান সমাজে, একজন নারী দেশের, দশের কিংবা সমাজের কল্যানে যত অবদানই রাখুক না কেন, আমরা তাঁকে তাঁর উপযুক্ত সম্মান দিই না। নারীর প্রতি পুরুষজাতির এহেন অসামঞ্জস্য আচরনের প্রেক্ষিতে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীরা রয়েছেন পিছিয়ে। অথচ সেই মাতৃজাতি নারীই যুগে যুগে জন্ম দিয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত মনীষাদের। তাদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, মায়া-মমতা ও আদর-যত্ন বিহনে এই পৃথিবী হত শুস্ক মরুভূমির মত প্রাণহীন। মাতৃজাতির এই নির্লোভ, অক্লান্ত ত্যাগের মহিমা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি আরও লিখেছেন –

জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,

মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান। (সঞ্চয়িতা, ৭৫)

অধ্যাপক ডক্টর জিনবোধি মহাথেরের মাতা, প্রয়াত স্নেহলতা বড়ুয়া, যাকে আমরা – যারা উনার নাতীর বয়স্ক – বুড়িভাই বলে ডাকতাম, ছিলেন এমন এক মহীয়সী নারী, যার অকৃত্রিম ত্যাগে দেশ হয়েছে ধন্য এবং বৌদ্ধ-সমাজ হয়েছে গৌরবান্বিত। তিনি ছিলেন ত্যাগের যেন এক বিমূর্ত প্রতীক। তাঁর এ ত্যাগ প্রতিভাত হয় ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর এক সন্তানকে হারানোর মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে একজন মায়ের কাছে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে উনার তরুণ সন্তানের মৃত্যু-সংবাদ শোনা। সন্তান হারানোর বেদনা যে কি করুণ একমাত্র সেই জানে যিনি তা স্বয়ং উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু বুড়িভাই তাতে এতটুকুও ভেঙ্গে পড়েননি। সংসারকে টেনে নিয়ে গেছেন দৃঢ়তার সাথে, একটুও বিচলিত না হয়ে। কিভাবে তিনি এতটা সুদৃঢ় হতে পেরেছিলেন? তার একটিমাত্র কারন হতে পারে। তিনি ছিলেন স্বধর্মপ্রাণ ও স্থিরচিত্তের অধিকারী। তাইতো একজন সন্তানকে হারানোর পরও তিনি তাঁর আরেকজন সন্তানকে বুদ্ধ-শাসনে দান কতে দ্বিধা করেননি। যে কিনা বাঙ্গালী বৌদ্ধ সমাজে আজ অধ্যাপক ডক্টর জিনবোধি মহাথের নামে পরিচিত। এবং যিনি আজ বাঙ্গালী বৌদ্ধ জাতির উন্নয়ন কল্পে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ সংস্কারমূলক নানাকাজে নিজেকে ব্যাপ্ত রেখেছেন।

বুড়িভাইয়ের তিন ছেলের মধ্যে দু’জন যখন এভাবে ঘর ছেড়ে চলে যান, বাকিজন সংসারের হাল ধরেন। কিন্তু নিয়তির এমন পরিহাস, মরনব্যাধির কবলে পড়ে তাকেও মায়ের আঁচল ছেড়ে অকালে পাড়ি জমাতে হল পরপারে। এভাবে একাকী ছেলেবউ ও নাতী-নাতনীদের নিয়ে কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন। কিভাবে একজন নারী এমনভাবে ত্যাগ-মহিমায় উদ্দীপ্ত হতে পারেন? কি এমন শক্তির জোরে সে সদাপ্রানোদ্দীপ্ত হয়ে জীবন কাটাতে পারেন তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমি একটা কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি – তিনি ছিলেন একজন মহীয়সী নারী। ধর্মই ছিল তাঁর পথচলার একমাত্র সাথী। সেটা দেখা যায় তাঁর জীবনে। সারাজীবন সংসারের এত ব্যাস্ততার পরও কখনও কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান তিনি বাদ দেননি। বিশেষকরে রাঙ্গুনীয়ার যেকোনো মন্দিরে যেকোনো ধর্মসভাই হোক না কেন বুড়িভাই সেখানে উপস্থিত থাকতেন। ধর্মের প্রতি তাঁর এহেন অগাধ শ্রদ্ধা সম্ভবত তাঁকে মানসিক শক্তি যোগাত, যেটার প্রেক্ষিতে সে জীবনের সমস্থ ঝর-তুফান উপেক্ষা করে একটি শান্ত-সুসমাহিত ও সুন্দর জীবন পরিচালনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

বুড়িভাইকে আমি কাছ থেকে দেখেছি ও জেনেছি ২০০১ সালে যখন আমি তাদের বিহারে থাকতে যাই। কদল্পুর ভিক্ষু প্রশিক্ষন কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক নানা কাজের চাপে আমার পড়ালেখা যখন প্রায় বন্ধ হতে চলল। যখন দেখছি পড়ালেখার সমস্ত দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন বন্ধু ভিক্ষু রাহুলানন্দের সহায়তায় আমি তাদের বিহারে চলে আসি। সেখানে আসার পর প্রায় এক বছরকাল আমি থেকেছি। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট করছি পাহাড়তলীর ইমাম গাজ্জালী ডিগ্রী কলেজে। বিহারে অবস্থানকালীন সময়ে প্রায় প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় চার/পাঁচজন বয়স্ক উপাসক ও উপাসিকা বিহারে আসতেন এবং বুদ্ধবন্দনাদি করে বিহারের বারান্দায় বসে নানা ধর্মীয় আলোচনায় ব্যাপ্ত থেকে সময় কাটাতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বুড়িভাই। বিহারে দু’এক দিনের মধ্যেই উনার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। প্রতিদিন বিহারে আসলেই তিনি আমাকে বলতেন – শ্রমন, আমাকে কিছু বন্দনা শিখিয়ে দাও।

আমি বলতামঃ            বুড়িভাই, আপনিতো অনেক বন্দনা জানেন, আর শেখার দরকার কি?

বুড়িভাই বলতেনঃ       আগে আরো বেশি জানতাম, এখন অনেক ভুলে গেছি।

উনার বয়স তখন প্রায় ৯০ বৎসর। আমি অবাক হতাম এবয়সেও উনার শেখার আগ্রহ দেখে।

অনেক প্রশ্ন করতাম বুড়িভাইকে। কখনও বিন্দুমাত্র বিরক্ত হতেন না। আমি জিজ্ঞেস করতাম – কত বছর বয়সে আপনার বিয়ে হয় বা আপনি এ গ্রামে কখন আসেন? কত ক্লাস পর্যন্ত আপনি পড়ালেখা করেছেন? কিভাবে এতসব বন্দনা শিখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিতেন খুবই শান্তভাবে। বলতেন, বঙ্গীশ থের নামের একজন ভিক্ষু ছিলেন উনাদের গ্রামের বিহারে। ছোটবেলায় ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাড়ার আরও দু’একজন মিলে বিহারে যেতেন বুদ্ধকে ফুল-পানি তোলতে ও বন্দনা করতে। সেসময় বঙ্গীশ থের তাদেরকে নানাধরনের বন্দনা, সূত্র ও গাথা শেখাতেন। সেগুলোই তাঁর এখনও মনে আছে। আমাকে বলতেন ভালভাবে পড়ালেখা কর। পারালেখা না করলে বড় হওয়া যায় না। কিভাবে শ্রদ্ধেয় উপসংঘরাজ সুগতবংশ মহাথের দেশনা দিতেন, তিনি যে অনেক বই লিখেছেন সেসব আমাকে তিনি বলতেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর এমনতর আগ্রহ দেখে আমি স্বতঃই অবাক হতাম।

প্রায়শই বিহারে আসলে জিজ্ঞেস করতেন আমার কিছু লাগবে কিনা। জিজ্ঞেস করতেন, সকালে কি খেয়েছি, দুপুরে কলেজে যাব কিনা ইত্যাদি। ভোরে যখন আসতেন বাড়ীতে পিঠা-পুলি যা কিছুই তৈরী হোক না কেন – হাতে করে দু’একটা নিয়ে আসতেন আমার জন্য। এখনও সেসব স্মৃতি মনে পড়লে চোখ জলভর্তি হয়ে উঠে। স্বার্থ-অন্বেষী এ পৃথিবীতে যখন দেখি চারিদিকে শুধু ঈর্ষা-হানাহানি, মিথ্যা ও শঠতার বড়াই, তখন বুড়িভাইয়ের স্নেহজরিত উপদেশাবানীর কথা বারবার মনে পড়ে। ২০০২ সালে ডক্টর জিনবোধি মহাথেরের উপাধ্যায়ত্বে যখন আমি উপসম্পদা গ্রহন করি পাহাড়তলীর মহানন্দ সঙ্ঘরাজ বিহারের ভিক্ষুসীমায়, আমার উপসম্পদা-দায়িকা বা ধর্মমাতা হন বুড়িভাই। তাঁর দানকৃত চীবর, ও ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে বুদ্ধশাসনে ধর্মশিক্ষা ও ধর্মদানে ব্রত থেকে জীবনোৎসর্গ করার ব্রত গ্রহন করি। তাই আমার ভিক্ষু জীবনের অর্জিত সমস্থ পুন্যরাশি আমি প্রতিনিয়ত তাঁহার উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করি।

কিছু কিছু মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকেন তাঁদের অমায়িক আচার-ব্যাবহারের জন্য, তাদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার জন্য, তাদের অতিসাধারন ও নিরাসক্ত জীবনের জন্য। স্নেহলতা বড়ুয়া বা বুড়িভাই সেরকমই একজন মানুষ। পৃথিবীতে যে কয়জন ভাল মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, বুড়িভাই তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি যতদিন বেঁচে থাকব তাঁর স্মৃতি আমার অন্তরে আম্লান থাকবে। তাঁর উন্মুক্ত মানসিকতা, শান্ত-শিষ্ট অবয়ব, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং সর্বোপরি স্নেহপরায়নতা ও মমত্ববোধ সবসময় আমাকে অনুপ্রাণিত করবে। বুড়িভাই যেখানেই জন্ম নিয়ে থাকুক না কেন আমার বিশ্বাস উনি সুখে এবং শান্তিতে আছেন, কেননা সারাজীবন তিনি দেশের ও দশের মঙ্গল কামনাই করেছেন।

পালিসাহিত্যের ধর্মপদের একটি গাথা বুড়িভাইয়ের ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। সেটা হচ্ছে –

ইধ নন্দতি, পেচ্চ নন্দতি, কতপুঞঞো উভয়ত্ত নন্দতি;

পুঞঞং মে কতন্তি নন্দতি, ভিয়্যো নন্দতি সুগগতিং গতো। (ধম্মপদ, ১৮)

অর্থাৎঃ কৃতপুন্য ব্যাক্তি ইহলোক ও পরলোক উভয়ত্রই আনন্দিত হন। আমার দ্বারা পুন্য করা হইয়াছে, ইহা স্মরন করিয়া তিনি আনন্দিত হন এবং সুগতি প্রাপ্ত হইয়া তিনি পরমানন্দ লাভ করেন। (ধর্মাধার ভান্তে কতৃক অনুবাদিত)

আমার দৃঢ় বিশ্বাস বুড়িভাই সুগতি প্রাপ্ত হয়েছেন এবং ইহলোকে কৃত পুন্যের কারনে পরলোকেও তিনি পরমানন্দেই আছেন।

থাইল্যান্ডে প্রবারণার অভিজ্ঞতা

ভিক্ষু জ্ঞানবোধি

আষাঢ়ী পূর্নিমা থেকে আশ্বিনী পূর্নিমা পর্যন্ত সুদীর্ঘ তিন মাস বর্ষাব্রত শেষে এই পবিত্র প্রবারণা পূর্নিমানুষ্ঠান আসে। সকল থেরবাদ বৌদ্ধ দেশে অনুষ্ঠানটি প্রায় একযোগেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে প্রবারণা হয় একদিনের ব্যবধানে। বাংলাদেশে একদিন আগে হয় আর থাইল্যান্ডে হয় একদিন পরে। যদিও উভয় দেশে অনুষ্ঠানের কার্যক্রমের বিভিন্নতা দেখা যায়, মূল আদর্শ বা উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন।

প্রবারণার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে এইদিন বর্ষাব্রতী সকল ভিক্ষুসংঘকে বিহারের দায়ক-দায়িকাগণ পুঁজো ও সম্মান জানাবেন। কেননা তাদের বিহারে অবস্থানরত সমস্থ ভিক্ষুসংঘ গত তিনমাস পর্যন্ত বিনয়ানুসরনের মাধ্যমে ধর্মচর্চা করেছেন। তারা আধ্যাত্মিক সাধনার অনুশীলন করেছেন। এখন তারা আবার বের হবেন ধর্ম প্রচারার্থে বিভিন্ন জনসমাগমে। বর্তমানে এর ব্যবহারিক সত্যতা যাই হোক না কেন, বৌদ্ধ বিনয়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুসারে এঠাই হচ্ছে ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সকল থেরবাদ বৌদ্ধ দেশে বর্ষা-যাপন, প্রবারণা উদযাপন ও কঠিন চীবর দানোৎসব হয়ে থাকে।

দেখা যাক থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠানটি কিভাবে হয়। প্রবারণার আগের দিন বিকাল থেকে মাইকে ধর্মীয় সিডি বা ক্যাসেট চালানো হয়। পরদিনের অনুষ্ঠান এবং তার গুরত্ব সম্পর্কে ঘোষনা করা হয়। সকল ভিক্ষু সংঘ সেদিন মস্তক মুন্ডন করে ফেলে। পরদিন সকালে যথারীতি পিন্ডপাত বা ভিক্ষান্ন সংগ্রহ শেষে সকল ভিক্ষু ও শ্রমণ সংঘকে উপস্থিত হতে হবে দান-শালায়। সেখানে ততক্ষণে অনেক উপাসক-উপাসিকা এসে পড়েছেন। এবং তারা ভিক্ষুসংঘের জন্য প্রাতরাশ তৈরী করছেন. ভিক্ষু ও শ্রমণ সংঘ সারিবদ্ধ হয়ে দান-শালায় প্রবেশ করেন এবং নিজেদের আসন গ্রহণ করেন। এর পর উপস্থিত গৃহীসংঘ বুদ্ধকে বন্দনান্তে সংঘকে বন্দনা নিবেদনের মাধ্যমে আহার উত্সর্গ করেন। ভিক্ষুসংঘও বুদ্ধকে বন্দনা নিবেদনের মাধ্যমে সুত্রপাঠ করেন সকলের মঙ্গলের অন্য. এর পর সংঘ যখন তাদের প্রাতরাশ গ্রহণ করেন ঠিক একই সময়ে একজন ভিক্ষু শীলাদি ধর্মদেশনা প্রদান করেন গৃহীসংঘকে। প্রাতরাশ শেষে ভিক্ষু-শ্রমণ সংঘ ধর্য্যসহকারে অপেক্ষা করেন ধর্মদেশক ভিক্ষুর জন্য। ঐ ভিক্ষুটির ধর্ম-দেশনা শেষে গৃহী-সংঘ আবার বুদ্ধ-সহ ভিক্ষু-শ্রমণ সংঘকে শ্রদ্ধা ও বন্দনা নিবেদন করেন। এদিকে ভিক্ষু সংঘও বুদ্ধ বন্দনা শেষে আশির্বাদ দেন গৃহিদেরকে। এরপর সারিবদ্ধ হয়ে দানশালা হতে প্রস্থান করেন। একটি কথা এখানে উলেখ করা প্রয়োজন যে থাইল্যান্ডের প্রতিটি বিহারে ৫০-৬০ জনের মত ভিক্ষু সংঘ থাকেন। সুতরাং বিহারের সব ধর্মীয় আয়োজন খুব সমারোহের সাথে সম্পাদিত হয়।

গৃহী-সংঘ সেদিন পুরোটা দিন কাটায় বিহারে নানারকম ধর্মীয় চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে। বিকাল সাড়ে তিনটায় সকল ভিক্ষু-সংঘ সীমাঘরে উপস্থিত হয়ে বুদ্ধ বন্দনা ও ভিক্ষুদের আপত্তি দেশনাদি সম্পাদন করেন। এরপর ভিক্ষুদের বর্ষাবাস অনুসারে ক্রমান্বয়ে একে একে প্রবারণা গাথা আবৃত্তি করেন-‘সংঘং ভন্তে, পবারেমি, দিট্ঠেন বা সুতেন বা পরিসংখায় বা বদন্তু মং আয়স্মন্তু অনুকম্পং উপাদায়, পস্সন্ত পটিক্করিস্সামি’। এদিকে গৃহী-সংঘকে কোনো এক ভিক্ষু কর্তৃক বৈকালিক ধর্ম দেশনা দেওয়া হয়। উল্লেক্ষ্য যে এদেশে ফানুস উত্তোলনের তেমন বিশেষ কোনো প্রথা নেই। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় বাংলাদেশী ভিক্ষু-সংঘগণ এসময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময় ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে ফানুস উত্তোলন করে থাকেন। কিন্তু এখানে প্রবারণার শেষ নয়। পরদিন সকালে প্রত্যেক বিহারে গণপিন্ডপাতের আয়োজন করা হয়। বিহারের সমস্থ ভিক্ষু সংঘ সারিবদ্ধ হয়ে পিন্ডপাত করেন এসময়। দাযকগণ পিন্ডপাত শুরু হওয়ার পূর্বে বুদ্ধ বন্দনা ও পঞ্চশীল গ্রহণ করেন এবং ভিক্ষু গণ তাদেরকে ‘অভিবাদেন সীলস্স…’ বলে আশির্বাদ প্রদান করেন। এভাবে থাইল্যান্ডে প্রবারণা অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়ে থাকে।