কোসম্বিয়সুত্ত: বা বিবাদ মুক্তির উপায়!

তথাগত বুদ্ধ তখন কৌশম্বীর ঘোসিতারামে অবস্থান করছিলেন। একসময় তথায় অবস্থানরত ভিক্ষুদের দুই দলের মধ্যে এক কঠিন বিবাদের সৃষ্টি হয়। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে ধারালো বাক্যের ছুরি ছুঁড়তে থাকে। কেউ কাউকে রাজি নয়। এমন সময় জনৈক ভিক্ষু বুদ্ধের কাছে গিয়ে ব্যাপারটি বুদ্ধকে অবহিত করে। বুদ্ধ বিবাদ-রত ভিক্ষুদেরকে তাঁর কাছে ডেকে আনবার জন্য আদেশ দেন। তাঁরা আসলে বুদ্ধ ঘটনার সত্যতা যাচাই করে তাদেরকে বলেন; নির্বোধ, সহব্রহ্মচারীদের ভিতর এরূপ ঝগড়া-বিবাদ ও বাদানুবাদের মধ্যে কোনও প্রকার মৈত্রীর প্রকাশ পায় না। এটা সবার জন্যই ক্ষতিকর এবং দুঃখপূর্ণ।

তারপর বুদ্ধ বলেন যে ছয়টি বিষয় আছে যেগুলো প্রত্যেকের স্মরণ রাখা কর্তব্য কেননা সেগুলোর চর্চায় প্রীতিভাব,  ঐক্য, শান্তি, সম্মান, সাম্যভাব, এবং সামগ্রিকতার বৃদ্ধি হয়। সে ছয়টি বিষয় হল:

১) কায়িকভাবে প্রকাশ্যে কিম্বা গোপনে সহব্রহ্মচারীদের প্রতি মৈত্রীর চর্চা করা,

২) বাচনিকভাবে মৈত্রী চর্চা করা,

৩) মানসিকভাবে মৈত্রী চর্চা করা,

৪) নিজের সদ্ধর্ম প্রতিপালনে লব্ধ বস্তুসমূহ (এমনকি নিজ পাত্রের আহারপর্যন্ত) কোনোপ্রকার আপত্তিকর মনোভাব ছাড়া সহব্রহ্মচারীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা।

৫) প্রকাশ্যে এবং গোপনে অখণ্ডিত, অছিদ্র, নিষ্কলঙ্ক, বিমুক্তিপ্রদায়ী, বিজ্ঞদের প্রশংসিত, অনিস্প্রভ, সমাধিস্থাপক, শীলপালনে সব্রহ্মচারীদের সাথে বাস করা।

৬) সব্রহ্মচারীদের সঙ্গে আর্য্য ও বিমুক্ত চিন্তা-ধারার সাথে বসবাস করা উচিত যেটা দুঃখের পরিসমাপ্তি সদনে সহায়ক।

একটি দালানের সর্বোচ্চশিখড়ের মত এই ছয়টি বিষয়ের মধ্যে শেষেরটিই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তারপর বুদ্ধ বর্ণনা করেন কিভাবে এই আর্য্য ও বিমুক্ত দৃষ্টির মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে দুঃখক্ষয় করা সম্ভব।

একজন ভিক্ষু অরণ্যে, রুক্ষমূলে, কিংবা শুন্যাগারে ভাবনানুশীলন করতে গিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে – তাঁর মধ্যে অপরিত্যাক্ত কোনো আসক্তি কিংবা দুর্বলতা আছে কিনা যা তার বিমুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যদি সে দেখতে পায় যে তার মধ্যে কামতৃষ্ণা, হিংসা বা পরশ্রীকাতরতা (পালি:-ব্যাপাদ), অলসতা ও নিস্ক্রীয়ভাব (পালি:-থীনমিদ্ধ), অস্থিরতা বা ঔদ্ধত্যভাব, সংশয় বা বিচিকিৎসা (পালি:-বিচিকিচ্ছা) বিদ্যমান এবং সে ইহলোক বা পরলোকের চিন্তায় সদামগ্ন, সহব্রহ্মচারীদের সঙ্গে বিবাদপরায়ণ তাহলে বুঝতে হবে তাঁর মন আসক্তি-পরিব্যাপ্ত। মন এরূপ অপরিত্যাক্ত আসক্তি ও দুর্বলতায় পরিব্যাপ্ত থাকার কারণে সে চতুরার্য্য সত্য সম্পর্কে যথাভূত জ্ঞান লাভ করতে পারে না। এই বোধ থেকে তাঁর প্রথম জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এর দ্বারা লব্ধ অন্তরের প্রশান্তিকে বুঝতে পারা হচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় জ্ঞান। বুদ্ধের শিক্ষার বাইরে অন্য কেউ এরূপ শিক্ষা দেয না জানাই হচ্ছে তাঁর তৃতীয় জ্ঞান। নিজের মধ্যে সম্যক দৃষ্টি আছে কিনা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে তাঁর কৃত বিন্দুমাত্র অপরাধেরও প্রকাশ এবং সেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য সংযমতা অবলম্বণ হচ্ছে তাঁর চতুর্থ জ্ঞান। সম্যকদৃষ্টি প্রতিপন্ন হয়ে সহব্রহ্মমচারীদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মব্যাস্ততার পরও অধিশীল বা উন্নততর শীল, অধিচিত্ত, এবং অধিপ্রজ্ঞা বৃদ্ধির জন্য সচেতন হওয়া হচ্ছে তাঁর পঞ্চম জ্ঞান। সদ্ধর্মশ্রবণে পূর্ণমনযোগ এবং উৎসাহ বা শক্তি স্থাপন করা হচ্ছে তাঁর ষষ্ট জ্ঞান। এবং সদ্ধর্ম দেশনায় তার অর্থবোধ, ধর্মবোধ, এবং ধর্মে প্রমোদ লাভ করাটাই তাঁর সপ্তম জ্ঞান।

এই সপ্ত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে সে স্রোতাপত্তিফল লাভ করতে সক্ষম হয়।

(মধ্যম নিকায়, কোসম্বিয় সুত্র)

অনঙ্গণসূত্র-কলঙ্ক বা দোষ মুক্ত হওয়ার উপায়!

শ্রাবস্তির জেতবন বিহারে অবস্থানকালে ভদন্ত সারিপুত্র মহাস্থবীর একদিন ভিক্ষুদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন – বন্ধুগণ, পৃথিবীতে চার ধরনের মানুষ বিদ্যমান:

১) যিনি নিজের মধ্যে কলঙ্ক বা দোষ থাকার পরও বুঝতে পারে না যে তার মধ্যে কলঙ্ক আছে।

২) যিনি নিজের মধ্যে যে কলঙ্ক আছে সেটা বুঝতে পারে।

৩) যিনি নিজের মধ্যে কলঙ্ক নেই কিন্তু বুঝতে পারে না যে তার মধ্যে কলঙ্ক নেই।

৪) যিনি নিজের মধ্যে যে কলঙ্ক নেই সেটা বুঝতে পারে।

এই চারজনের মধ্যে প্রথম এবং তৃতীয় জন নিজেদের কলঙ্ক সম্পর্কে যেহেতু অজ্ঞাত, তাদের কাছ থেকে এটা কখনো প্রত্যাশা করা যায় না যে কলঙ্ক মুক্ত হওয়ার জন্য তারা কোনও প্রকার প্রচেষ্টা করবে। কলঙ্কিত ব্যক্তি কলুষিত মন নিয়েই মৃত্যু বরণ করে। অপরপক্ষে দ্বিতীয় এবং চতুর্থ জন নিজেদের কলংক সম্পর্কে যেহেতু সজাগ, তাদের ক্ষেত্রে এটা প্রত্যাশা করা যায় যে তারা এই কলংক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সর্বপ্রকারের প্রচেষ্টা করবে। বিমুক্ত, নিষ্কলুষ এবং পবিত্র মন নিয়েই তারা মৃত্যু বরন করবে।

কলঙ্ক শব্দটির দ্বারা এখানে কি বুঝানো হচ্ছে?

এখান কলঙ্ক শব্দটির দ্বারা বুঝানো হচ্ছে পাপী বা অকুশল মানসিকতা নিয়ে থাকা এবং তত্সাথে অকুশল ও দুঃখ প্রদায়ক কর্ম সম্পাদন করা।

কোনো কোনো ভিক্ষু তাদের এরূপ আশা বা কামনার জন্য কুপিত এবং বিমর্ষ হয়ে থাকে। যেমন, তারা আশা করে তাদের অপরাধ অন্য কেউ না জানুক, কৃত অপরাধ সঙ্ঘের মধ্যে প্রকাশিত না হয়ে ব্যাক্তিগত ভাবে প্রকাশ হোক। সমপদের কেউ যেন অপরাধের জন্য উপদেশ দেয়। শাস্তা যেন তাদেরকে প্রাধন্য দিয়েই দেশণা দেন। পিণ্ডপাত ভ্রমণে সর্বাগ্রে যেন স্থান হয়। সর্বোত্তম আহারাদি যেন লাভ হয়। তাদের যেন ধর্মদেশণা দেওয়ার সুযোগ হয়। সবাই যেন তাদের সম্মান করে। উত্তম চীবর, আহার, বাসস্থান এবং ঔষধ যেন লাভ হয়। এভাবে তাদের কামনা যদি আশানুরূপ না হয় তাহলে তারা অত্যন্ত কুপিত এবং বিমর্ষ হয়।

অনুরূপ ব্যক্তি তার অকুশল বা পাপ চিন্তা পরিত্যাগ না করে যদিওবা অরণ্যে, সুদূর গ্রামে, পিণ্ডপাত করে, ছিন্ন বা অমার্জিত চীবর পরিধান করে কঠোর সন্যাস জীবন যাপন করে তাঁকে কেউ শ্রদ্ধা বা সম্মান দেখাবে না। একটি অত্যন্ত সুপরিচ্ছন্ন, উজ্জ্বল ও ঝকঝকে বাটিতে একটা মৃত সাপ বা কুকুরের পঁচা মাংস নিয়ে যাওয়ার সময়, একজন ক্ষুদার্ত ব্যাক্তি হয়তো উজ্জ্বল বাটি দেখে আকৃষ্ট হবে ঠিকই কিন্তু যেইমাত্র সে ভেতরের প্রকৃত জিনিস সম্পর্কে জানতে পারবে, ঘৃণায় দুর্গন্ধে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তেমনই অন্তরের অকুশল চিন্তা পরিত্যাগ না করে লোক দেখানো সন্যাস জীবন যাপন করলে কেউ তাকে প্রকৃতপক্ষে শ্রদ্ধা বা সম্মান করবে না।

ভদন্ত সারিপুত্র এরূপ বললে মৌদ্গল্যায়ন থেরও তাঁর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলেন এবং জীবিকার জন্য মিথ্যাচার না করে সৎভাবে প্রকৃত সন্যাসজীবন যাপন করবার জন্য জোর দেন। এভাবে এ দুই মহাপুরুষ একজন আরেকজনের সুভাষিত বানীর প্রশংসা করেণ। তাদের এরূপ আলোচনায় উপস্থিত ভিক্ষুগণ পুলকিত হয়ে সাধুবাদের সহিত অনুমোদন করেন।

(মধ্যম নিকায়, অনঙ্গণসূত্র)

অনাত্মা-লক্ষণ সূত্রঃ পঞ্চস্খন্ধের স্বরুপ

এই সুত্রটি বুদ্ধ সারনাথের ঋষিপতন মৃগধাবে উনার পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে উদ্দেশ্য করেই দিয়েছিলেন। এখানে বুদ্ধ অস্তিত্বের ত্রিলক্ষণ যথাঃ অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্মা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। ধর্মচক্রপ্রবর্তন সুত্র দেশনার পর তিনি দেখলেন যে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের মধ্যে একমাত্র কোণ্ডান্যই বুঝতে পেরেছেন তাঁর দেশনার মর্মার্থ। অন্যেরা তখনো পরিপূর্ণরূপে বুঝে উঠতে পারেনি. তাই তিনি তাদেরকে এই বিশেষ সুত্রটি দেশনা করেন।

এখানে বুদ্ধ বলেন যে পঞ্চস্কন্ধ: রূপ, বেদনা, সঙ্গা, সংস্কার ও বিজ্ঞান যেগুলোর সুবিন্যস্ত সমন্বয়ে ব্যক্তি গঠিত তার সবই অনিত্য, দুঃখপ্রদায়ক ও আত্মাহীন। কেননা রূপ ইত্যাদি যদি আত্মা হত তাহলে সেগুলো দুঃখ প্রদান করত না। নিজের রূপ ইত্যাদি সম্পর্কে সবাই বলতে পারতো যে আমার রূপ, বেদনা, সঙ্গা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এরূপ হোক; এরূপ না হোক। রূপ ইত্যাদি যেহেতু আত্মা নয় সেহেতু কেউ তার নিজের রূপ ইত্যাদি সম্পর্কে এরূপ বলতে পারে না।

বুদ্ধ আরো বলেন, যেটা অনিত্য সেটা সুখকর হতে পারে না। কোনো বিষয় যে অনিত্য ও দুঃখ প্রদায়ক সেটির সে অবস্থা থেকেই এটা প্রমানিত হয় যে সে বিষয়টি আত্মাহীন। যদি বিষয়টির কোনখানে বিন্দুমাত্রও আত্মার অস্তিত্ব থাকতো তাহলে সেটা পরিবর্তন হত না। এবং বিষয়ের অপরিবর্তনে দুঃখের উত্পাদন আশাব্যঞ্জক। সুতরাং বুদ্ধ উনার শিষ্যদেরকে উপদেশ দেন যে পরিবর্তনশীল, দুঃখপ্রদায়ক ও আত্মাহীন কোনো বিষয়কে ‘আমি’, ‘আমার’ কিংবা ‘আমার আত্মা’ বলাটা উন্মত্তের বৃথা প্রলাপ ছাড়া আর কিছু না। সেজন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান রূপ ইত্যাদি পঞ্চস্খন্ধকে সম্যকভাবে জানতে। যাতে করে কেউ উত্পন্ন, অনুত্পন্ন, সুক্ষ্ণ, স্থুল, অতীত, অনাগত সমস্থ প্রকার রূপ ইত্যাদি পঞ্চস্খন্ধকে ‘আমি’, ‘আমার’ কিংবা ‘আমার আত্মা’ বলে না জানে। বরঞ্চ ‘আমি নয়’, ‘আমার নয়’ কিংবা ‘আমার আত্মা নয়’ বলে জানে।

সূত্রটি শ্রবনে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের সকলেই পঞ্চস্খন্ধ হতে নিবৃত হয়, বীতরাগ হয়, বিমুক্ত হয়, এবং বিমুক্তজ্ঞান লাভ করে তাদের চিত্ত আশ্রব থেকে মুক্ত হয়।

[বিনয় পিটকে মহাবর্গপালি ১ম খন্ড, ১৩ পৃষ্ঠা]

আকাঙ্খেয়সূত্র:- ভিক্ষুর আকাংখিত বিষয় এবং সেগুলো লাভ করবার উপায়

বুদ্ধ তখন শ্রাবস্তির জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। যথারীতি একদিন তিনি ভিক্ষুদের আহ্বান করে তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন – ভিক্ষুগণ, তোমরা শীল, প্রাতিমোক্ষ ও প্রাতিমক্ষসংবরনশীলে সুনিয়িন্ত্রিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বাস কর। অনুমাত্র দোষেও ভয় জ্ঞান হয়ে শিক্ষাপদ সমূহ পালন করে নিজেদেরকে সুপ্রশিক্ষিত কর। তাহলে একজন ভিক্ষুর তার ভিক্ষু-উচিত আখাংকা সমূহ কোনরূপ বাধা ছাড়াই পরিপূর্ণ হবে।

একজন ভিক্ষুর হয়তো ইচ্ছা হতে পারে – এই পবিত্র  সন্যাস জীবনে আমি যেন আমার সহব্রহ্মচারীদের মধ্যে সুপ্রিয়, গণ্য এবং সম্মানিত হই; যেন প্রয়োজনীয় চীবর, বাসস্থান, আহার, ও ঔষধাদি লাভ করতে পারি; আমাকে এই বিষয়সমূহ দান করে দাতাগণ যেন মহাপুণ্যফল লাভ করতে সক্ষম হয়;  যেন রতিহীন নিরাসক্ত হয়ে দিনাতিপাত করতে পারি; যেন ভয় বা ত্রাশ আমাকে অভিভুত না করে; যেন ইচ্ছা হলেই কোনও প্রকার কষ্ট বা অসুবিধা ছাড়া ধ্যানের চারি স্থর লাভ করতে সক্ষম হই; যেন সশরীরে শান্ত-সমাহিত বিমোক্ষ সুখ লাভ করতে পারি যেটা রূপ-লোককে অতিক্রম করে; যেন রাগ, দ্বেষ, মোহ এই ত্রিসংযোজন ক্ষয় করে স্রোতাপন্ন হয়ে পতনের সম্ভাবনারহিত হয়ে বিমুক্তিসুখ লাভ করতে পারি; যেন নিম্নগামী (ওরম্ভাগীয়) সংযোজন সমূহ পরিপূর্ণরূপে ক্ষয় করে ঔপপাতিক প্রাণী হয়ে জন্মগ্রহণ করি এবং সেখান থেকেই নির্বাণ লাভ করতে সক্ষম হই; যেন নানারকম অলৌকিক ঋদ্ধি যেমন: দেয়াল ভেদ করে কিংবা পানির উপর গমনাগমন করা, দিব্যশ্রুতি (দূরের এবং কাছের, দৈব এবং পার্থিব সকল শব্দ শুনতে পারা), পরচিত্ত ও চিত্তের প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারা, নিজের বা অপরের পূর্বজন্মসমূহ স্মরণ করতে পারা, সত্ত্বগণের চ্যুতি ও উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে পারা, ইত্যাদি ক্ষমতার অধিকারী হতে পারি; এবং যেন ইহজন্মেই স্বয়ং চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি উপলব্ধি করতে পারি। কোনো ভিক্ষুর চিত্তে যদি এরূপ আকাঙ্ক্ষার সৃষ্ঠি হয়ে থাকে তাহলে বুদ্ধের উপদেশ হল: – “ভিক্ষুগণ, শীলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে অবস্থান কর। চিত্ত সংবরন করে প্রশান্ত চিত্তে সমাধিস্থ হও, ধ্যানে অবহেলা না করে বিদর্শণ ভাবনায় রত হও, এবং শুন্যাগারে বাস কর। এভাবে তোমাদের সমস্থ আখাংকা পরিপূর্ণ হতে পারে। ভিক্ষুগণ বুদ্ধের এরূপ দেশনা শুনে আনন্দিত হন এবং সাধুবাদের সহিত তা অনুমোদন করেন।

(মজ্ঝিমনিকায়, মূলপন্নাস, মূলপরিয়ায়বজ্ঞ, আকাংখ্যেয়সুত্ত)

দ্বিবিধবিতর্কসুত্র: দুই প্রকারের চিন্তা

এই বিশেষ সুত্রটি বুদ্ধ শ্রাবস্তিতে জেতবনের অনাথপিন্ডিক আরামে অবস্থানকালে দেশনা করেন। এখানে বুদ্ধ উনার শিষ্যদেরকে দুই প্রকারের চিত্ত-বিতর্ক বা চিন্তা সম্পর্কে শিক্ষা দেন। তিনি বলেন, ভিক্ষুগণ আমার বুদ্ধ হওয়ার পূর্বে যখন আমি বোধিসত্ব অবস্থায় পারমি পূরণ করছিলাম, আমার মনে এই দুই প্রকারের চিন্তার উদ্রেক হয়। তা হল:

১) কাম-চিন্তা, দ্বেষ-চিন্তা ও হিংসা-চিন্তা;

২) নৈস্ক্রম্য-চিন্তা, দ্বেষহীন-চিন্তা, ও মৈত্রী বা অহিংসা-চিন্তা।

এই সুত্রে বুদ্ধ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রথমত তিনি বলেন যে, কোনো ভিক্ষু যখন তার দৈনন্দিন কর্ম ভাবনানুশীলনে রত হন তার মনে কোনো না কোনো প্রকার চিন্তার উদ্রেক হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে, তারা এতই মোহপরায়ন ও বিপথগামী যে তারা বুঝতে পারে না কোন ধরনের চিন্তা তাদের মনে সৃষ্টি হচ্ছে বা হয়েছে। কিন্তু একজন ধ্যানপরায়ন ভিক্ষু সহজেই বুঝতে পারে যে তার মনে হয়তো উপরোল্লিখিত প্রথম প্রকার কিংবা দ্বিতীয় প্রকারের চিন্তার উত্পন্ন হয়েছে। যদি তার মনে প্রথম প্রকারের চিন্তা অর্থাৎ কাম-চিন্তা ইত্যাদি উত্পন্ন হয় এবং সে যদি তা সম্যকরূপে বুঝতে পারে যে তার সে চিন্তা নিজের, অন্যের কিংবা উভয়ের জন্য অহিতকামী তাহলে সে চিন্তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, কোনো চিত্ত কখনো চিন্তা মুক্ত থাকে না। সুতরাং অকুশল চিন্তা যখন বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছে সে মনে কুশল চিন্তা যথাঃ নৈস্ক্রম্য-চিন্তা ইত্যাদির সৃষ্টি হবেই। তখন একইভাবে সে ভিক্ষু বুঝতে পারে যে তার এ চিন্তা নিজের, অন্যের এবং উভয়ের জন্য হিতকামী ও মঙ্গলময়। সে যখন এরূপ চিন্তা করে তার চিত্তে উত্পন্ন কুশল চিন্তার স্থায়ী ও বৃদ্ধি সাধন হয়। কিন্তু বুদ্ধ বলেন এভাবে এমনকি কুশল চিন্তা নিয়েও দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করা উচিত নয়। কেননা এতে করে অনুশীলনকারী ভিক্ষু শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পরে এবং তা তার সাধনার অগ্রসরতায় বাঁধা সৃষ্টি করে। ভিক্ষু জীবনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধনার অনুশীলন ও আধ্যাত্মিকতায় উন্নতি সাধন করা। সেজন্য বুদ্ধ সবসময় মধ্যম পথের অনুশীলনের কথা বলে থাকেন। এক্ষেত্রেও বুদ্ধ বলেন অকুশল চিন্তা পরিত্যাগ করে কুশল চিন্তার সৃষ্টি ও তার সুখকর বিপাকের কথা ভাবা এবং আবার সেবিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তা না করে নিজের ভাবনানুশীলনে নিমগ্ন হওয়া হচ্ছে মধ্যম পথের অনুশীলন।

বুদ্ধ আরো বলেন মানুষ যেবিষয়ে সর্বদা চিন্তা করে সেটা তার কাছে অভ্যাস কিংবা সংস্কারে পরিনত হয়। এবং সেটা যদি খারাপ অভ্যাস হয় তাহলে তার সে অভ্যাস তার এবং তার চারপাশে অনেকের জীবনে অসামান্য দুঃখ বয়ে আনে। তিনি উক্ত সুত্রে দু’টি চমত্কার উদাহারনের মাধ্যমে খুবই পরিষ্কার করে বুঝিয়েছেন কিভাবে খারাপ চিন্তাসমূহকে পাহারা দেওয়া উচিত অন্যতায় তা কিরূপ ক্ষতি সাধন করতে পারে এবং কিভাবে ভাল চিন্তাসমূহকে খুবই নিশ্চিন্তে মনরুপ মাঠে বিচরণ করতে দেওয়া উচিত।

পরিশেষে বুদ্ধ উনার শিষ্যদেরকে আহ্বান করেন: হে ভিক্ষুগণ, আমার যা করার ছিল তোমাদের জন্য তা আমি করেছি, ভিক্ষুগণ, দেখ এই হচ্ছে বৃক্ষমূল, এই হচ্ছে শুন্যগৃহ; এখন তোমরা সেখানে বসে মনোযোগের সহিত ভাবনানুশীলন কর, দেরি কর না, অন্যতায় পরে অনুশোচনা করতে হবে।

ধম্মদায়দসুত্ত: কিভাবে ধর্মের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়?

এই সূত্রে প্রথমে বুদ্ধ ভিক্ষুদেরকে উপদেশ দিয়ে বলেন যে বস্তুগত বিষয়ে বুদ্ধের উত্তরাধিকারী না হয়ে ভিক্ষুরা যেন ধর্মের উত্তরাধিকারী হয়। নয়তো সাধারণ মানুষ তাঁদেরকে নিন্দা করবে। উদাহরণ দিয়ে বুদ্ধ বলেন, মনে কর কখনো তথাগত বুদ্ধ পর্যাপ্ত পরিমাণ আহার গ্রহনের পর কিছু খাবার অবশিষ্ট রয়েছে। এ সময় দুজন ভিক্ষু, যারা তখনও আহার করেনি, ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সেস্থানে প্রবেশ করে। বুদ্ধ তাদেরকে বলেন, ভিক্ষুগণ, আমার আহার সমাপ্ত হয়েছে এবং এখানে কিছু খাবার অবশিষ্ট আছে। তোমাদের ইচ্ছা হলে এই আহার গ্রহণ করতে পার, নয়তো আমি ঘাস এবং প্রাণী নেই এরূপ স্থানে ইহা নিক্ষেপ করব। বুদ্ধ এভাবে বলার পর প্রথম ভিক্ষু চিন্তা করল, বুদ্ধ যদিও আমাদেরকে এই অবশিষ্ট আহার গ্রহণের জন্য বলেছেন, তিনি এও বলেছিলেন যে ভিক্ষুরা যেন বস্তগত বিষয়ে নয়, ধর্মে তাঁর উত্তরাধিকারী হয়। সুতরাং, এই আহার গ্রহণ করা আমার উচিত হবে না। এই চিন্তা করে প্রথম ভিক্ষুটি আহার গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরের দিন প্রাতরাশ পর্যন্ত সে না খেয়ে ক্ষুদার্ত এবং দুর্বল হয়েই থাকল। বিপরীতে দ্বিতীয় ভিক্ষুটি চিন্তা করল বুদ্ধ পর্যাপ্ত পরিমানের আহার গ্রহণ করার পর কিছু অবশিষ্ট আছে যেটা বুদ্ধ ঘাস এবং জল নেই এরূপ স্থানে নিক্ষেপ করবেন। আমি এই আহার গ্রহণ করে ক্ষুদা নিবৃত করে সবল হযে রাত্রি যাপন করবো। এরূপ চিন্তা করে সে তাই করল। এই দুজনের মধ্যে, বুদ্ধ বলেছেন প্রথম ভিক্ষুটিই প্রশংসনীয় হবেন কারণ সে বস্তুগত বিষয়ে নয়, ধর্মেরই প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এক রাত কষ্ট হলেও, তাঁর স্বল্পেচ্ছা, সন্তুষ্টি, তপস্যা, এবং উদ্যমশীলতা এই গুণাবলিগুলির প্রভাবে ভিক্ষুটির চিন্তা বিমুক্তির পথে দীর্ঘমেয়াদি ফল বয়ে আনবে। বুদ্ধ এরূপ দেশণা দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন।

এরপর সারিপুত্র মহাস্থবীর একই বিষয়ের উপর বিস্তৃত করে বলেন কিভাবে ধর্মের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়। তিনি বলেন তিনটি বিষয়ে জৈষ্ঠ, মধ্যম, ও কনিষ্ট সকল বয়সের ভিক্ষুদের মধ্যে অনেকেই নিন্দনীয় কারণ তাঁরা বুদ্ধের উপদেশ যথাযথভাবে পালন করে না। সেই তিনটি বিষয় হচ্ছে –

১) বুদ্ধশিশ্যদের উচিত নির্জনবাস করা কিন্তু অনেকেই সেটা করে না।

২) বুদ্ধের আদেশানুসারে যে বিষয়াদি পরিহার করা উচিত (যেমন: লোভ, দ্বেষ, মোহ, কুঅভ্যাস ইত্যাদি) অনেকে তা করে না।

৩) তাঁরা বিলাসপ্রিয়, অসতর্ক, আর্য্যপথে অগ্রসরবিমূখ এবং নির্জনবাসে নারাজ।

যারা এ তিন প্রকার দোষ হতে মুক্ত তথাগত বুদ্ধ তাদেরকে প্রশংসা করেন। তারপর তিনি বলেন মানুষের প্রধান শত্রু বা পাপ হচ্ছে লোভ, দ্বেষ, ক্রোধ, আক্রোশ বা পরের অমঙ্গল কামনা, কপটতা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, মাত্সর্য্য,  প্রবঞ্চনা, শঠতা, অনমনীয়তা, উগ্রতা, দম্ভ, অতিদাম্ভিকতা, মোহ, প্রমত্ততা। এগুলো থেকে মুক্ত হবার জন্য আর্য্য অষ্টঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত মধ্যম পথ অবলম্বন করতে হবে।

(মজ্ঝিমা নিকায়, মূলপণ্ণাস, মূলপরিয়ায়বজ্ঞ, ধম্মদায়াদসুত্ত)

নখশিখা সুত্র: কোনটা বেশি – নখাগ্রের বালি না সমস্ত পৃথিবীর বালি?

তথাগত বুদ্ধ তখন শ্রাবস্থিতে অবস্থান করছিলেন। প্রতিদিনের ন্যায় তিনি ভিক্ষুসংঘকে আহ্বান জানালেন ধর্মশালায় আসতে। ভিক্ষুগণ সবাই ধর্মশালায় এসে সারিবদ্ধ হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে বসে পড়লেন। বুদ্ধ ভাবনামগ্ন হয়ে বসে আছেন উনার আসনে। শিষ্যগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বুদ্ধের অমৃতবাণী শোনার জন্য। বুদ্ধ কোমলতার সহিত তাঁর চোখদুটি খোললেন। তাঁর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের নখশিখায় কিছু বালুকা তিনি তুলে নিলেন। তারপর তা শিষ্যদেরকে দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন: ভিক্ষুগণ, তোমরা কি মনে কর? – আমার নখাগ্রের এই বালি এবং পৃথিবীর সমস্থ বালির মধ্যে কোনটার পরিমান বেশি? ভিক্ষুগণ ত্বরিত উত্তর দিলেন – প্রভু, আপনার নখাগ্রের বালি পৃথিবীর সমস্থ বালির তুলনায় তো কিছুই নয়। আপনার নখাগ্রের এই বালি খুবই সামান্য আর পৃথিবীর সমস্থ বালি অসীম, অনন্ত। এটা তো কোনভাবে তুলনা করা যায় না।

তারপর বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে বললেন: ভিক্ষুগণ, অনুরুপভাবে যারা এ পৃথিবীতে মানুষরূপে জন্মগ্রহণ করেন তাদের সংখ্যা আমার নখশিখার এ বালির মত অতীব সামান্য। আর যারা অন্য ভিবিন্ন কুলে বা স্থানে জন্মগ্রহণ করে তাঁদের সংখ্যা অনেক বেশি। মনুষ্যজন্ম লাভ করা এতই কঠিন, এতই দুরহ। তাই আমি তোমাদেরকে বলি তোমরা সবসময় স্মৃতিমান হয়ে অবস্থান করবে। মনুষ্যজন্ম যে দুর্লভ সেবিষয়ে সবসময় চিন্তা করবে এবং স্মৃতিসম্প্রজ্ঞান হয়ে নিজেকে আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর করবে।

(সংযুক্ত নিকায়, নিদান বর্গ, উপমা সংযুক্ত, নখশিখা সুত্র)

বত্থূপম সুত্র: কায়বিশুদ্ধি নয়, চিত্তবিশুদ্ধিই সকলের কাম্য হওয়া উচিত

তথাগত বুদ্ধ এই বিশেষ সুত্রটি শ্রাবস্থির জেতবনারামে অবস্থারত ভিক্ষুদিগকে উদ্দেশ্য করেই করেছিলেন।

একটি অপরিচ্ছন্ন নোংরা কাপড় যেকোনো রঙের পানিতে ভিজিয়ে তোল না কেন সেটাকে অপরিস্কার এবং নোংরা দেখাবে। অনুরূপভাবে একটি অপরিচ্ছন্ন কলুষিত মন থেকে একমাত্র দুঃখময় গতিই প্রত্যাশা করা যায়। একটি পরিস্কার উজ্জ্বল কাপড় যদি রং করা হয় সেটাকে খুবই পরিস্কার এবং সুরঞ্জিত দেখাবে। অনুরূপভাবে একটি পবিত্র নিষ্কলুষ মনের গতি সর্বদা সুখময় হবে প্রত্যাশা করা যায়।

অপরিস্কার বা কলুষিত মনের হেতু বা কারণ হচ্ছে – অবিদ্যা, লোভ, হিংসা, ক্রোধ, অজ্ঞানতা, প্রতিহিংসাপরায়নতা, বিদ্বেষভাব, অন্যের ক্ষতি কামনা, ঈর্ষা, মাৎসর্য্য বা ধনলিপ্সা, মায়া, শঠতা, ধৃষ্টতা, দম্ভ, অহমিকা, প্রমাদ বা শ্রমবিমুখতা ইত্যাদি।

একজন ভিক্ষু যিনি আধ্যাত্বিক উন্নতি প্রত্যাশা করেন এবং পরম শান্তি নির্বাণ কামনা করেন তিনি উপরোল্লিখিত কারণসমূহ যে চিত্তের অকুশল অবস্থা সেটা জেনে খুব দ্রুতই সেগুলো পরিত্যাগ করে। বুদ্ধের, ধর্মের ও সঙ্ঘের গুণাবলী স্মরনের মাধ্যমে অন্তরে অঢেল শ্রদ্ধা ও ভক্তি উৎপাদন করে। উক্ত ত্রিরত্নের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাপ্রবণ হয়ে অন্তরে প্রীতিলাভ করে। ধর্মের অর্থ জ্ঞাত হয়ে প্রেরণা লাভ করে, ধর্মজ্ঞান লাভ করে, এবং ধর্মে প্রমোদ লাভ করে। এর ফলে তাঁর মনে প্রীতির উদয় হয়, শরীরে প্রশান্তি বিরাজ করে, প্রশান্ত কায়ে সে সুখ অনুভব করে, সুখী হয়ে তাঁর চিত্ত সমাধিস্থ হয়।

এরূপ শীলবান, সমাধিপরায়ন ও প্রজ্ঞাসবান ভিক্ষু যদি বিবিধ স্যুপ ও ব্যাঞ্জনযুক্ত উত্তম আহার বা পিন্ড ভোজন করে তাঁর অন্তরায় হবে না। একটি অপরিচ্ছন্ন নোংরা কাপড় যেমন পরিস্কার জলে ধোবন করলে পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, একইভাবে একজন ভিক্ষু তাঁর শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার গুনে কায়িক, বাচনিক ও মানসিক ভাবে পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। সে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা সহগত চিত্ত হয়ে দম্ভ, বৈরী ও প্রতিহিংসা বর্জিত হয়ে বাস করে।

সে বুঝতে পারে যে নীচ, হেয় কিংবা উচু সংজ্ঞাসমূহের অতিক্রমের পথ রয়েছে। এভাবে জানবার এবং দেখবার ফলে তার মন কাম-আসব, ভব-আসব ও অবিদ্যাসব থেকে বিমুক্ত হয়। বিমুক্ত হয়ে তাঁর বিমুক্ত-জ্ঞান উৎপন্ন হয়, জন্ম পরিগ্রহ ক্ষীণ হয়, ব্রহ্মচর্য্য বাস করা হয়, কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন হয়। এইটাই হচ্ছে চিত্ত-বিমুক্তি।

দেশনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সুন্দরিকা ভারদ্বাজ নামে একজন ব্রাহ্মণ। সে জানতে চায় ভগবান গৌতম বাহুকা নদীতে স্নান করতে যান কি না। কারণ ভারদ্বাজের শাস্ত্র অনুসারে বাহুকা নদীতে স্নান করে পরিশুদ্ধি লাভ করা যায়। এর প্রত্যুত্তরে বুদ্ধ কিছু গাথা আবৃত্তি করলেন। তাঁর সারমর্ম হল বিভিন্ন নদীতে স্নান করে পরিশুদ্ধি লাভ কামনার চেয়েও মনের মধ্যে সদ্গুণাবলী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে পবিত্র হওয়াটাই উত্তম স্নান। এই দেশণা শুনে সুন্দরিকা ভারদ্বাজ অত্যন্ত প্রীত হয় এবং বুদ্ধের নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

বিতর্কসন্থান সুত্র – অকুশল-চিত্ত-বিতর্ক হতে মুক্তির উপায়!

তথাগত বুদ্ধ শ্রাবস্থীর জেতবনে অনাথপিন্ডিকের আরামে অবস্থানকালে উপস্থিত ভিক্খুদেরকে উদ্দেশ্য করে এই সুত্রটি দেশনা করেন।

বুদ্ধ বলেন, কোন ভিক্ষু যদি ভাবনানুশীলনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতায় উন্নতি লাভ করতে চায়, তার নিন্মলিখিত পাঁচটি বিষয়ে জ্ঞান থাকা উচিত।

১) ভাবনানুশীলনের সময় কোন অপ্রত্যাশিত নিমিত্ত বা বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়ার প্রেক্ষিতে তার অন্তরে যখন লোভ, দ্বেষ ও মোহ সম্প্রযুক্ত অকুশল চিত্তের বা চিত্ত-বিতর্কের উদয় হয় তাকে সে চিত্ত-বিতর্ক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কোন কুশল বা উন্নত বিষয়ের প্রতি মনযোগ দিতে হবে। এতে করে তার মন কলুষমুক্ত হয়ে শান্ত, সমাহিত ও সমাধিস্থ হবে।

২) কিন্তু এতে যদি তার অকুশল চিত্ত দমিত না হয় তাহলে তাকে অকুশল চিত্ত জনিত দুঃখজনক বিপাকের কথা ভাবতে হবে।

৩) এতেও যদি কিছু না হয় তাহলে তার উচিত হবে উত্পন্ন অকুশল-চিত্ত-বিতর্ককে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা বা ভুলে থাকা।

৪) এতেও যদি সেটা না যায় তাহলে তাকে তার উত্পাদিত-অকুশল-চিত্ত-বিতর্কের হেতু-প্রত্যয় বা কারণ সমূহকে সম্যকভাবে জানতে হবে এবং সেগুলো সমূলে উত্পাঠনের প্রচেষ্ঠা করতে হবে।

৫) যদি উপরোক্ত চারটি উপায়ই বিফলে যায় তাহলে তাকে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে – তার দাতের নিচের অংশ দিয়ে জিহ্বাকে মুখের উপরের অংশের সাথে জোরে চেপে ধরতে হবে এবং এভাবে চিত্তকে চিত্ত দিয়ে দমন করতে হবে।

উল্লেক্ষ্য যে, বুদ্ধ অকুশল-চিত্ত-বিতর্ক দমন করার উপরোক্ত পাঁচটি উপায় পাঁচটি খুবই উপযুক্ত উপমার সাথে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন – কেউ যদি এভাবে অকুশল-চিত্ত-বিতর্ক দমনের পাঁচটি উপায়ের যেকোন একটি কিংবা  সব পদ্ধতি অবলম্বন করে তাহলে অবশ্যই তার সে চিত্ত-বিতর্ক দমিত হবে। অকুশল-চিত্ত-বিতর্ক দমনে সফল সে ভিক্ষুকে তখন চিত্ত-বিতর্ক-পথে শ্রেষ্ঠ পুরুষ (বসী বিতক্কপরিয়ায়পথেসু) বলা হয়ে থাকে। সে চিন্তার স্বাধীনতা লাভ করে। যখন যেবিষয়ে চিন্তা করতে চায় তখন সেবিষয়ে সে চিন্তা করতে পারে। কেননা তার সমস্থ সংযোজন, তৃষ্ণা, মান সর্বোপরি দুঃখের পরিসমাপ্তি হয়েছে। সে তখন একজন বিমুক্ত আর্যপুরুষ।

(মধ্যম নিকায়, সিংহনাদ বর্গ, বিতর্কসন্থান সুত্র)

ভয়ভৈরবসুত্র: কিভাবে ভয়কে অতিক্রম করা যায়?

বুদ্ধ শ্রাবস্থীর জেতবন বিহারে যখন বাস করছিলেন জানুসসোনি নামের এক ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে জিজ্ঞ্যেস করেণ কিভাবে বুদ্ধের নির্দেশে যুবকগণ গৃহত্যাগ করে গভীর বনে ভীতিসঙ্কুল নির্জন পরিবেশে একটা নিরানন্দ জীবন যাপন করতে উৎসাহী হয়। উত্তরে বুদ্ধ বলেন সম্বোধি লাভের পূর্বে বোধিসত্ত্ব অবস্থায় তাঁর মনেও এরূপ সংশয়ের উদয় হয়েছিল। বুদ্ধ বলেন, মানুষ কায়িক, বাচনিক, ও মানসিকভাবে, অকুশল বা অপবিত্র কর্ম করে থাকলে তার মনে ভয়ের উদয় হয়। অন্যথা পরিশুদ্ধ কাজ বা জীবিকা নির্বাহ করে থাকলে তার মনে ভয়ের উদয় হয় না। এইভাবে, বুদ্ধ বলেন কিরূপ অকুশল চেতনা বিদ্যমান থাকলে মনে ভীতির উদয় হয় যেমন, লোভী বা পরধন লোলুপতা, পরশ্রীকাতরতা, অস্থীর, উদ্বিগ্ন, অশান্তচিত্ত হওয়া, সন্দেহভাজনতা, আত্মপ্রশংসায় মগ্ন হয়ে অন্যকে হীন জ্ঞান করা, ভীত-চিত্ত হওয়া, নিয়ত লাভ-সম্মান-খ্যাতি কামনা করা, পরিশ্রম-বিমুখী, হীনবীর্য্য হওয়া, বিস্মরণশীল, অমনোযোগী হওয়া, অসমাহিত বিভ্রান্তচিত্ত হওয়া, দুস্প্রাজ্ঞ, ও মূর্খ হওয়া। বুদ্ধ বলেন তিনি যখন সম্বোধি লাভের পূর্বে অরন্যে সাধনা করছিলেন তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে তাঁর মধ্যে এই অকুশলগুলো বিদ্যমান ছিল না। বরঞ্চ তিনি ছিলেন নির্লোভ, মৈত্রীচিত্ত, উপশান্ত, সংশয়হীন, হীনমন্যতাবিহীন, নির্ভীক, স্বল্পেচ্ছুক, বীর্য্যবান, পরিপূর্ণরূপে স্মৃতিমান, সমাধিপরায়ন, এবং প্রজ্ঞাপরায়ন। তারপর তিনি আরও বলেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে ভয় বা আতঙ্কের উদ্রেক হলে সে মুহূর্তে কিরূপ চিন্তার মাধ্যমে শারীরিক মানসিকভাবে প্রশান্ত হয়ে প্রজ্ঞার সাথে তিনি সেটা প্রতিহত করতেন। ভয়কে প্রতিহত করে তিনি সমাধিস্থ হতেন এবং প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ ধ্যান সমূহ উপলব্ধি করতেন। এইভাবে চিত্ত ক্লেশবর্জিত, পরিশুদ্ধ, উজ্জ্বল, হয়ে সম্বোধির পথে অগ্রসর হয় অবিদ্যা সমূলে বিনাশ হয়। এই সূত্রে বুদ্ধ পুর্বজন্মের স্মৃতি জ্ঞান, দিব্যচক্ষু, এবং আসবক্ষয় জ্ঞান, এই ত্রিবিদ্যা সম্পর্কেও উল্লেখ করেন।

তারপর, ব্রাহ্মণকে, উদ্দেশ্য করে বুদ্ধ বলেন, ব্রহ্মন, তোমার হয়তো মনে হতে পারে যে ভগবান গৌতম বোধ হয় এখনও রাগ, দ্বেষ, মোহাদি আসব থেকে মুক্ত হয়নি যেকারণে তিনি এখনো গভীর অরণ্যে গিয়ে ধ্যান অনুশীলন করেন। কিন্তু ব্রহ্মন এইখানে আমি দ্বিবিধ উপকার প্রত্যক্ষ করেই ধ্যানাশীনুলন করি। প্রথমত, আমি এখানে নিজে বাস করবার জন্য একটা মনোজ্ঞ পরিবেশ দেখতে পাই,  দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতের প্রজন্মের প্রতি করুণা পরবশ হয়ে।