সম্যকদৃষ্টি সুত্র: ‘সম্যকদৃষ্টি’ আসলে কি?

বুদ্ধ তখন শ্রাবস্থির জেতবনে অনাথপিন্ডিকের আরামে অবস্থান করছিলেন। সারিপুত্র ভান্তেও ছিলেন সাথে। দূর-দুরান্ত থেকে অনেক ভিক্ষু এসেছে বুদ্ধকে দর্শন করতে এবং উনার মূখ থেকে কিছু ধর্মবাণী শুনতে। সম্বভতঃ উনি আজ কিছুটা ক্লান্ত। তাই সারিপুত্র ভান্তেকে বললেন শিষ্যরা কি চায় দেখতে। শিষ্যরা সারিপুত্র ভান্তেকে দেখে অবাক ও মুগ্ধ হলেন। এতবড় জ্ঞানী ভিক্ষু, স্বয়ং বুদ্ধ কতৃক প্রশংসিত এমন ভিক্ষুর সহজে দেখা মেলে না। প্রাথমিক সম্ভাষণ শেষে সারিপুত্র ভান্তে তাদেরকে বললেন: ভিক্ষুগণ, সবাই ‘সম্যকদৃষ্টি’, ‘সম্যকদৃষ্টি’ বলে থাকে। তোমরা কি জান ‘সম্যকদৃষ্টি’ আসলে কি? ভিক্ষুগণ বললেন, ভান্তে, আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি বুদ্ধ কিংবা আপনার মতো পণ্ডিত মহাথেরর কাছ থেকে কিছু ধর্মভাষণ শুনতে। অনুগ্রহ করে আপনি আমাদেরকে বুঝিয়ে বলুন ‘সম্যকদৃষ্টি’ আসলে কি? সারিপুত্র ভান্তে বললেন, ঠিক আছে তাহলে আমি বলছি, তোমরা মনোযোগের সাথে শোন।

কোন ভিক্ষু যখন প্রাণীহত্যা, মিথ্যা-পরুষ-পিশুন-সম্প্রলাপ বাক্য ভাষণ, ব্যভিচার, চুরি, লোভাতুর কর্ম, হিংসা ও মিথ্যাদৃষ্টি ইত্যাদি অকুশল কর্ম ও এদের মূল যেমন: লোভ, দ্বেষ, মোহ এবং উপরোক্ত কর্মসমূহ থেকে বিরত থাকা ও নির্লোভ, দ্বেষহীন, সম্যকদৃষ্টি প্রতিপন্ন হওয়ার মত কুশল কর্ম ও এদের মূল যেমন অলোভ, অদ্বেষ, অমোহ সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

সারিপুত্র ভান্তের এরূপ বর্ণনা শুনে ভিক্ষুগণ অভিভূত হন এবং জানতে চান অন্যভাবে বর্ণনা করা যায় কিনা. সারিপুত্র ভান্তে বললেন তোমরা শোন আমি এক এক করে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করছি।

কোন ভিক্ষু যখন চার প্রকারের আহার যথা: কবলিকৃত আহার, স্পর্শ আহার, মনোসনচেতনা আহার ও বিজ্ঞান আহার, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন চতুরার্য্যসত্য যথা: দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন জরা ও মৃত্যু, এদের কারণ, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন জন্ম, জন্মের কারণ, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন ভব, ভবের কারণ, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন চারি উপাদান যথা: কামুপাদান, দৃষ্টি-উপাদান, শীল-ব্রত উপাদান ও আত্মাবাদ উপাদান, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন ছয় প্রকারের তৃষ্ণা যথা: রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও চিন্তা, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন ছয় প্রকারের বেদনা যথা: চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন ছয় প্রকারের স্পর্শ যথা: চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন ষড়াযতন যথা: চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন নাম ও রূপ, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন ছয় প্রকারের বিজ্ঞান যথা: চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও মন, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন তিন প্রকারের সংস্কার যথা: কায়, বাক্য ও মন-সংস্কার, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন চতুরার্য্যসত্য সম্পর্কে না জানার মত অবিদ্যা, অবিদ্যার উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

কোন ভিক্ষু যখন তিন প্রকারের আশ্রব যথা: কাম-আশ্রব, ভব-আশ্রব, ও অবিদ্যা-আশ্রব, এদের উৎপত্তি, নিরোধ ও নিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত হয় তখন সেটাকে ‘সম্যক দৃষ্টি’ বলে।

এভাবে উপরোক্ত বিষয়াদি সম্যকভাবে জ্ঞাত হয়ে একজন ভিক্ষু প্রকৃতপক্ষে সম্যকদৃষ্টি সম্পন্ন হয়, ঋজুদৃষ্টি সম্পন্ন হয়, সে সদ্ধর্মে শ্রদ্ধা সম্পন্ন হয় এবং ধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

(মধ্যম নিকায়, সম্যকদৃষ্টি সুত্র)

সর্বাসবসূত্র: বা আশ্রব হতে মুক্তির উপায়!

তথাগত বুদ্ধ তখন শ্রাবস্থির জেতবনে অনাথপিন্ডিকের আরামে অবস্থান করছিলেন। যথারীতি উপযুক্ত সময় বুঝে তিনি তথায় অবস্থিত ভিক্ষুসংঘকে আহ্বান করেন এবং এই বিশেষ সুত্রটি দেশনা করেন।

তিনি বলেন যে আশ্রব ক্ষয় করা তার পক্ষেই সম্ভব যিনি ধর্মকে সম্যকভাবে জানেন ও বোঝেন। আর যিনি ধর্মকে সম্যকভাবে জানেন না ও বোঝেন না তার পক্ষে আশ্রব ক্ষয় করা অসম্ভব। তিনি আরো বলেন – অজ্ঞতার সহিত কোন বিষয়ের প্রতি মনোযোগ স্থাপনে অনুৎপন্ন অকুশল মনোবৃত্তি উৎপন্ন হয় এবং উৎপন্ন অকুশল মনুবৃত্তি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। অপরপক্ষে প্রজ্ঞার সহিত কোন বিষয়ের প্রতি মনোযোগ স্থাপনে অনুৎপন্ন অকুশল মনোবৃত্তি উৎপন্ন হয় না এবং উৎপন্ন অকুশল মনোবৃত্তি বিনষ্ট হয়।

এরপর তিনি ভিক্খুদেরকে বর্ণনা করেন যে শুধুমাত্র সাধনার ক্ষেত্রে নয় দৈনন্দিন জীবনেও আমরা নানারকম আশ্রবের মুখোমুখি হই। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক নানারকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হই। এই সুত্রে বুদ্ধ সেসমস্থ বাধা-বিপত্তিকে আশ্রব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি সমস্থ আশ্রবকে সাত ভাগে বিভক্ত করেছেন এবং সেসব থেকে মুক্তির জন্য সাতটি উপায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। আশ্রব থেকে মুক্তি হওয়া যেতে পারে: ১) দর্শনের দ্বারা, ২) সংযমের দ্বারা, ৩) ব্যাবহারের দ্বারা, ৪) ক্ষান্তি বা ধর্য্যের দ্বারা, ৫) পরিবর্জনের দ্বারা, ৬) উৎপাঠন বা বিনাশ সাধনের দ্বারা, এবং ৭) ভাবনার দ্বারা।

দর্শনের দ্বারা:

অনেকেই আছেন যারা সাধনার সময় অনুপযুক্ত ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয় এবং যেকারণে তাদের মধ্যে লোভ, দ্বেষ ও মোহ সম্প্রযুক্ত অকুশল মনোবৃত্তি সৃষ্ঠি ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সে মনোযোগী হয়ে ভাবতে থাকে – ১) আমি কি অতীতে ছিলাম নাকি ছিলাম না? ২) আমি কি বর্তমানে আছি নাকি নেই? ৩) আমি কি ভবিষ্যতে থাকব নাকি থাকব না? ইত্যাদি। এসব বিষয়ে যখন সে মনোযোগী হয় তখন তার মধ্যে আত্মা-অনাত্মা সম্পর্কিত নানা ধারণার সৃষ্ঠি হয়। যেমন: আমার আত্মা আছে, আমার আত্মা নেই, আমার আত্মা ও আমি এক, অথবা আমার আত্মা ও আমি ভিন্ন ইত্যাদি। এভাবে সে যখন বিভিন্ন দৃষ্টির জালে আবদ্ধ হয়ে পরে তখন সেখান থেকে সে আর বেরুতে পারে না। এভাবে সে সংসার চক্রে ঘুরতে থাকে ও বারম্বার দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে। এরূপ ব্যক্তির উচিত সম্যকভাবে চারি আর্য্য সত্য সম্পর্কে জানা ও বোঝা। কেননা চতুরার্য্যসত্যের সম্যক দর্শনে সে উপরোক্ত দৃষ্টিজ্বাল কিংবা আশ্রব থেকে মুক্তি পেতে পারে। এটা হচ্ছে দর্শনের দ্বারা আশ্রব-মুক্তি।

সংযমের দ্বারা:

কোনো ব্যক্তি (ভিক্ষু) যখন তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় – যথা: চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক সম্পর্কে সর্বদা অসংযত থাকে তখন তাকে নানা রকম রোগ, শোক ও পরিতাপে পড়তে হয়। সেজন্য তার উচিত সবসময় পঞ্চইন্দ্রিয়কে পাহারা দেওয়া বা সংযমে রাখা সেভাবে সে রোগ, শোক, পরিতাপ থেকে মুক্ত হতে পারে। এটা হচ্ছে সংযমের দ্বারা আশ্রব-মুক্তি।

ব্যবহারের দ্বারা:

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও ঔষধাদির ব্যবহার আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের জন্যে, নিজের সৌন্দর্য্য রক্ষার জন্য কিংবা শক্তি বাড়ানোর জন্য নয়। তাই এ চতুর্প্রত্যয়ের ব্যবহার করতে হবে মনোযোগের সহিত আধ্যাত্মিকতার উন্নতি সাধনের কথা মাথায় রেখে। অন্যতায় সে রোগ, শোক ও পরিতাপগ্রস্ত হবে। এটা হচ্ছে ব্যবহারের দ্বারা আশ্রব-মুক্তি।

ক্ষান্তি বা ধর্য্যের দ্বারা:

কেউ যখন ক্ষুধা, তৃষ্ণা, মশা, মাছি, সূর্যের তাপ, বায়ু, অসৎ বাক্য, গালি-গালাজ ইত্যাদির মুখোমুখি হবে তখন তাকে রাগান্বিত কিংবা অনুরূপ অসদাচরণ না করে ধর্য্যের সাথে তা অতিক্রম করতে হবে। এটা হচ্ছে ধর্য্যের দ্বারা আশ্রব-মুক্তি।

পরিবর্জনের দ্বারা:

কোন ভিক্ষু যখন বন্য হাতি, ঘোড়া, মহিষ, কুকুর, সাপ ইত্যাদি নানারকম পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় তখন তাকে সে স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। যেস্থান তার জন্য ভাবনার উপযোগী। এভাবে পরিবর্জনের দ্বারা সে আশ্রব থেকে মুক্তি পেতে পারে।

উৎপাঠনের দ্বারা:

রাগ, দ্বেষ, হিংসা, মাৎসর্য্য, মোহ, অজ্ঞানতা ইত্যাদি থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে সেসব অকুশল মনোবৃত্তি সমূলে উৎপাঠন করতে হবে। এটা হচ্ছে উৎপাঠনের দ্বারা আশ্রব-মুক্তি।

ভাবনার দ্বারা:

কোনো ভিক্ষু সাধনায় উন্নতি সাধন করতে হলে তাকে সপ্তবোধ্যাঙ্গ যেমন: স্মৃতি, ধর্মবিচার, বীর্য্য, প্রীতি, প্রস্রদ্ধি, সমাধি ও উপেক্ষার গভীর অনুশীলন করতে হবে এবং এভাবে তার মনকে প্রশান্ত ও সমাহিত করে সে বিমুক্তি সুখ উপলব্ধি করতে পারেন। এটা হচ্ছে ভাবনার দ্বারা আশ্রব-মুক্তি।

উপরোক্ত সাত প্রকারে যিনি বিভিন্ন রকমের আশ্রব হতে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন – তাকে সর্ব-আশ্রব-মুক্ত (সব্বাসবসমবরসংবুতো)পুরুষ বলা হয়ে থাকে। সে সমস্থ প্রকারের তৃষ্ণা, মান ইত্যাদি সংযোজন ছেদন করেছে এবং তার সমস্থ দুঃখের অন্তঃসাধন হয়েছে।

ভিক্ষুগণ বুদ্ধের এরূপ দেশনা শুনে অতীব পুলকিত হন এবং সাধুবাদের সহিত তা অনুমোদন করেন।

অনুমান সুত্র: কিভাবে একজন ভিক্ষুর নিজেকে পর্যালোচনা করা উচিত?

একসময় মহামৌদগল্যায়ন থের ভাগ্গ রাজ্যে ভেসকলাবন মৃগধাবে সুংসুমারগির নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। তথায় তিনি অবস্থিত ভিক্ষুদেরকে ডেকে বললেন – ভিক্ষুগণ, কিছু কিছু ভিক্ষু আছে যারা বলেন যে ভান্তে আমাকে দেশনা করুন, আমাকে অনুশাসন করুন, আমি আপনার মুখনিঃসৃত বাণী শুনতে চাই। কিন্তু তাদেরকে অনুশাসন করা বা শিক্ষা দেয়া খুবই কঠিন। কেননা তারা খুবই অধর্য্যপরায়ন, যা বলা হয় তা মনোযোগ দিয়ে শোনে না। তাই অন্য ভিক্ষুরা মনে করেন তাকে দেশনা বা অনুশাসন করা উচিত নয়। কি কি কারণে তাদেরকে অনুশাসন করা কঠিন আমি বলছি:

১) যে ভিক্ষু পাপচিন্তায় মগ্ন, এবং পাপচিন্তা দ্বারা পরিচালিত, ২) যে ভিক্ষু নিজের প্রশংসা করে ও অন্যের নিন্দা করে, ৩) যে ভিক্ষু ক্রোধপরায়ন ও ক্রোধ দ্বারা পরিচালিত, ৪) যে ভিক্ষু ক্রোধপরায়ন এবং প্রতিহিংসা পরায়ন, ৫) যে ভিক্ষু ক্রোধপরায়ন এবং শক্ত, কঠিন ও জেদী, ৬) যে ভিক্ষু ক্রোধপরায়ন ও হিংসাত্মক বাক্য বলে, ৭) যে ভিক্ষু তিরস্কৃত এবং তিরস্কারকের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ, ৮) যে ভিক্ষু তিরস্কৃত হয়ে তিরস্কারকের মানহানিমূলক কাজ করে, ৯) যে ভিক্ষু নিজে তিরস্কৃত হয়ে তিরস্কারকের তিরস্কার করে, ১০) যে ভিক্ষু নিজে তিরস্কৃত হয়, সত্যের অপলাপ করে, কথা নারাচারা করে, ক্রোধ ও হিংসা প্রতিপন্ন হয়ে থাকে. ১১) যে ভিক্ষু তিরস্কৃত হয় এবং এর সাথে তার অসদাচরণের সম্পর্ক খুঁজে পায় না, ১২) যে ভিক্ষু ধৃষ্ট ও দাম্ভিক, ১৩) যে ভিক্ষু হিংসুটে ও মাৎসর্য্য পরায়ন, ১৪) যে ভিক্ষু ষঠ ও প্রবঞ্চক, ১৫) যে ভিক্ষু স্বার্থপর ও অতিমানী, ১৬) যে ভিক্ষু নিজস্ব মতবাদে বিশ্বাসী, সেটাকে শক্ত করে ধরে রাখে এবং সহজে ছাড়তে পারে না, তাদেরকে অনুশাসন করা খুবই কঠিন।

আবার কিছু ভিক্ষু আছে যারা বলে না যে ভান্তে, আমাকে দেশনা করুন, আমাকে অনুশাসন করুন ইত্যাদি। কিন্তু তারা ধর্য্যপরায়ন, শান্ত ও মনোযোগী। তাই অন্য ভিক্ষুরা মনে করেন তাদেরকে দেশনা বা অনুশাসন করা যায়। যেসমস্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদেরকে অনুশাসন করা যায় তা হচ্ছে উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্য সমূহের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এভাবে উপরোল্লিখিত বিষয়াদি জেনে একজন ভিক্ষুর উচিত নিজেকে পর্যালোচনা ও অনুমান করা। এভাবে তার চিন্তা করা উচিত যে, কেউ যদি খারাপ বা পাপচিন্তামগ্ন হয়ে বাস করে তাহলে তাকে আমি প্রিয় ভাবতে পারি না, অনুরুপভাবে আমিও যদি পাপচিন্তামগ্ন হই আমাকেও অন্যেরা পছন্দ করবে না। এভাবে নিজেকে অনুমানের মাধ্যমে বুঝে তার উচিত হবে পাপচিন্তা ইত্যাদি পরিত্যাগের প্রচেষ্টা করা এবং ভাল বা কুশল চিন্তা ইত্যাদির সৃষ্ঠির বা অনুশীলনের চেষ্টা করা। এভাবে সমস্ত পাপচিন্তার পরিসমাপ্তিতে সে অতিশয় আনন্দিত ও প্রীত হয় এবং দিবারাত্র সাধনায় মগ্ন হয়।

একজন পুরুষ, মহিলা, যুবক কিংবা যুবতী সেজে-গুজে যখন আয়নার সামনে গিয়ে যখন দেখে যে তার মুখে এখনো কিছু ময়লা রয়ে গেছে সে তখন সেটা ভালোভাবে পরিস্কার করে নেয় অনুরুপভাবে একজন ভিক্ষুও তার মনের ময়লা আছে কি নাই তা জেনে বারম্বার সাধনার মাধ্যমে তা পরিস্কারের চেষ্টা করে. এভাবে সে তার সাধনায় উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে এবং প্রীতি ও সুখ লাভ করে।

মহামৌদগল্যায়ন থেরর এরূপ ধর্মালোচনা শুনে ভিক্ষুগণ অতীব আনন্দিত হন ও সাধুবাদের সহিত তা অনুমোদন করেন।

প্রসঙ্গঃ কিভাবে জানব কোন মতবাদটা আসলে ঠিক?

১) একসময় ভগবান বুদ্ধ বৃহৎ ভিক্ষুসংঘ সহ বিচরন করতে করতে কালামাদের শহর কেসপুত্রে গিয়ে পৌঁছেন। কালামারা জানতে পারেন যে ‘ইনি সে ভগবান যিনি অরহত, সম্যক বুদ্ধ, বিদ্যা ও আচরন সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদু, অনুত্তর, পুরুষ দমনকারী সারথী, ও দেব-মানুশের শাস্তা। ইনি নিজে প্রথমে সম্যকভাবে সত্যকে উপলব্ধি করে পরে সেটা অন্যকে তার সুখের ও কল্যানের জন্য অর্থসহ ব্যাখ্যা করেন (সযং অভিঞ্ঞা সচ্ছিকত্ৰা পৰেদেতি)। কালামাগন অতিশয় উৎসুক্য হয়ে ভগবানের সাথে সাক্ষাত করেন। এবং তাদের আন্তরিক অভিবাদন শেষে নিন্মোক্ত আলোচনায় ব্রতী হন।

২) কালামাগন যখন বুদ্ধকে বলেন যে – বিভিন্ন সময়ে তাদের সে শহরে বিভিন্ন মতবাদের শ্রমণ-ব্রাহ্মনেরা আসেন। তারা নিজেদের মতবাদকে সকল যুক্তি তর্কের দ্বারা শ্রেষ্ঠ বলে উপস্থাপন করেন ও অন্য মতবাদকে ভুল ও অপ্রায়োগিক বলে প্রতিভাত করেন। এমতাবস্থায় তারা নিতান্তই দিশাহীন যে কোন মতবাদ সত্য আর কোনটা মিথ্যা। বুদ্ধ বললেন, এক্ষেত্রে তোমাদের বিচিকিৎসাগ্রস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি বলছি তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনঃ

images (4)৩) কালামাগন, যে কোন কিছু, শোনাকথায় বিশ্বাস কর না, পুরুষ পরম্পরাগত বলে বিশ্বাস কর না, এটা এরূপ বলে বিশ্বাস কর না, শাস্ত্রোক্তি বলে মেনে নিও না, যুক্তিতর্কে ঠেকে বলে মেনে নিও না, অনুমান বশতঃ মেনে নিও না, স্বীয় মতের সাথে মিলছে বলে মেনে নিও না, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ মেনে নিও না। কিন্তু যখন তুমি নিজে সঠিক জ্ঞানের দ্বারা জানবে যে ‘এটি অকুশল (অকুসলা), দোষজনক (সাবজ্জা) ও বিজ্ঞজন নিন্দিত (বিঞঞুগরহিতা)’ তখন সেমুহূর্তে সেটা বর্জন করবে।

৪) তারপর বুদ্ধ প্রশ্নোত্তরে কালামাবাসীদের ক্রমান্বয়ে জিজ্ঞ্যেস করেন – মানুষের মনে যদি লোভ, দ্বেষ, ও মোহ উৎপন্ন হয় সেটা ভালর জন্য না মন্দের জন্য? তিনি আরো ব্যাখ্যা করেন যে এ তিন অকুশল সংযুক্ত মানসিকতা নিয়ে মানুষ ‘প্রানীহত্যা, চুরি, ব্যাভিচার, মিথ্যা ও সুরা-পান সহ’ সমাজে নানা ধরনের অপরাধ করে থাকে এবং নিজের ও অন্যের দুঃখের কারণ হয়। অপরপক্ষে, এসব অকুশল মানসিকতামুক্ত হয়ে মানুষ ভাল ও সুখের কাজে ব্রতী হন এবং স্বীয় ও পরের সুখের কারণ হয়।

৫) বুদ্ধ কালামাদেরকে আরো বলেন যে, এভাবে কেউ অকুশল পরিত্যাগে কুশল কর্মে রত হলে সে চার রকমের আশ্বস্তি লাভ করে।

ক) প্রথম আশ্বস্তি হচ্ছে যে, যদি পরজন্ম থেকে থাকে এবং কুশলাকুশল কর্মের ফল থেকে থাকে, সারাজীবন কুশল কর্ম সম্পাদনহেতু মৃত্যুর পর সে সহজেই স্বর্গ প্রাপ্ত হবেন।

খ) দ্বিতীয় আশ্বস্তি হচ্ছে, এমনকি পরজন্ম যদি নাও থাকে, এবং কৃত কুশলাকুশল কর্মের ফল না থেকে থাকে, তবুও সে সুখী হবে এই ভেবে যে, সে এজীবনটা অন্তত ভাল বা সুখের কাজ করে অতিবাহিত করেছে।

গ) তৃতীয় আশ্বস্তি হচ্ছে, নিজের অজান্তে যদি কোনো পাপ কর্ম করেও থাকে তার অধোগতি পাপ্ত হওয়ার কিংবা দুঃখ ভোগের কোনো কারণ নেই। এবং

ঘ) চতুর্থ আশ্বস্তি হচ্ছে, যদি সে নিজের অজান্তে কোনোরূপ পাপ কর্ম না করে থাকে তাহলে সে উভয় দিকথেকে মুক্তহেতু ইহ কিংবা পরজন্মে কোনরূপ দুঃখ লাভের কারণ নেই।

এভাবে বুদ্ধ-কতৃক উক্ত সূত্র দেশিত হলে কালামাবাসীগন তা শুনে অতিশয় অবিভুত হন এবং আনন্দের সাথে অনুমোদন করেন।

[কেসমুক্তি সূত্র (বা কালামা সূত্র) – অঙ্গুত্তর নিকায়, মহাবর্গ – A-3.2.7.5-Kalama-sutta]