বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারী (ধর্মজ্ঞ সুত্রের আলোকে)

তথাগত বুদ্ধের ধর্ম হচ্ছে অমৃতপ্রদায়িনী। এধর্মের যথাযথ অনুশীলনে প্রত্যেকেই বিমুক্তিলাভে সমর্থ। যদিও সবার জন্য উন্মুক্ত, সম্বুদ্ধের এধর্ম সঠিকভাবে জানতে ও বুঝতে হলে একজন অভিজ্ঞ আচার্য বা শিক্ষকের সান্ন্যিধ্যের প্রয়োজন। কেননা বুদ্ধের ধর্ম অতীব সুক্ষ, গম্ভীর ও স্রোতের বিপরীতগামী। এ ধর্ম জ্ঞানীর ধর্ম। লোভ, দ্বেষ ও মোহে আচ্ছন্ন অশ্রুত, পৃথকজনের দ্বারা অধিগত করা সম্ভব নয়।

একজন অভিজ্ঞ আচার্য বা শিক্ষক হচ্ছেন তিনি যিনি ত্রিপিটকের অন্তর্ভুক্ত বুদ্ধের শিক্ষাসমূহকে যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছেন এবং তদনুসারে অনুশীলনে ব্রতী হয়ে নিজেকে আত্মশুদ্ধি ও আত্মমুক্তির পথে পরিচালিত করেছেন। এরূপ ভিক্ষুই হচ্ছে বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারী।

অঙ্গুত্তর নিকায়ের ধর্মজ্ঞ সূত্রানুসারে বুদ্ধধর্মের সঠিক অধ্যয়ন, অনুশীলন ও মানুষের মাঝে তা যথার্থরূপে প্রচারের জন্য একজন ভিক্ষুকে সাতটি গুনে গুণান্বিত হতে হবে। এ সপ্তগুন তাঁকে পঞ্চবিধ লাভ অর্জনে সহায়তা করে। কিন্তু এবম্বিধ সপ্তগুনে গুণান্বিত হতে হলে তাঁকে সুপ্রতিপন্ন, ঋজুমার্গ প্রতিপন্ন, ন্যায়প্রতিপন্ন ও সমীচীন প্রতিপন্ন হয়ে দৃঢ়তার সাথে বুদ্ধপ্রদর্শিত মার্গে অগ্রসর হতে হবে। নিন্মোক্ত ছকে উপরোল্লিখিত বিষয়সমূহ সুচারুরূপে তুলে ধরা হল।

abc

এ সপ্তগুনে গুণান্বিত ভিক্ষুই হচ্ছেন বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারী। কেননা তিনি স্বকীয় প্রচেষ্টায় বুদ্ধদেশিত ধর্ম অধিগত করেছেন এবং তাঁর অধিগত ধর্ম শুধুমাত্র নিজের মধ্যে ধরে না রেখে বিশ্বকল্যানে প্রচারে ব্রতী হয়েছেন। এখন দেখা যাক এ সপ্তগুন আসলে কি কি।

১) ধর্মজ্ঞঃ ধর্মজ্ঞ হওয়া মানে এককথায় ত্রিপিটকীয় গ্রন্থে রক্ষিত বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মবিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা। সূত্রানুসারে ধর্ম বলতে এখানে ‘নবঙ্গ সত্থুসাসন’ বা বুদ্ধের নয় প্রকার শিক্ষাকে বোঝানো হচ্ছে। যথাক্রমে – ১) সুত্র, ২) গেয়্য, ৩) ব্যাকরণ, ৪) গাথা, ৫) উদান, ৬) ইতিবুত্থক, ৭) জাতক, ৮) অদ্ভুদধর্ম, ও ৯) ভেদল্ল। অন্যকথায় বলতে গেলে গভীর অধ্যয়নের মাধ্যমে বুদ্ধ দেশিত সাঁইত্রিশ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্মে জ্ঞানার্জনকেই বলা হচ্ছে ধর্মজ্ঞ হওয়া।

২) অর্থজ্ঞঃ গ্রন্থে রক্ষিত শিক্ষাদি শুধুমাত্র তোতাপাখীর মতো মুখস্থ করে আওরালে চলবে না। এসবের যথাযথ অর্থও জানতে হবে। সঠিক ও যথার্থভাবে বুঝতে হবে কোন শিক্ষাটি লোকীয় অর্থপ্রদায়ক, কোনটি লোকুত্তর অর্থপ্রদায়ক, কোনটি নীত-অর্থবোধক কিংবা কোনটি নেঞঞ-অর্থবোধক ইত্যাদি। এভাবে সে তাঁর অনুসারীদের বলতে সক্ষম হবে যে – অয়ং ইমসস ভাসিতসস অত্থো – এটাই হচ্ছে এই বক্তব্যের যথাযথ অর্থ। অন্যতায় বুদ্ধ যেটা বলেছেন সেটা বলেননি বলে এবং যেটা বলেননি সেটা বলেছেন বলে প্রচার করলে, সে বুদ্ধের কথার অপব্যাখ্যার দোষে দোষী হবেন। সেজন্য বুদ্ধ মধ্যম নিকায়ের অলগর্দোপম সূত্রে তাঁর ধর্মের অধ্যয়নকারীদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তাঁর শিক্ষাসমূহ বিষাক্ত সাপের সাথে তুল্য। যদি কেউ সাপের লেজের দিকে ধরে তাহলে সেটা ঘুরে তাঁকে দংশন করবে। এবং সেই দংশনে সে হয়তো মারা যাবে অথবা মৃত্যুসম যন্ত্রনা অনুভব করবে। বুদ্ধের শিক্ষাও তদনুরূপ। ভুলভাবে কিংবা ভুল উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যাত হলে কারো মঙ্গল বয়ে আনবে না।

৩) আত্মজ্ঞঃ সেভিক্ষু শুধু ধর্মের অধ্যয়নে ও তাঁর অর্থ নিরূপণে থেমে থাকেন না। তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে নিজেকে বিচার করেন – তাঁর শ্রদ্ধা, শীল, শ্রুতি/শিক্ষা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও প্রতিভান কতটুকু উন্নত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, তথাগত বুদ্ধও বোধিলাভের পর বোধিবৃক্ষমূলে বসে বহুকষ্টে অধিগত তাঁর আত্মলব্ধ জ্ঞানের বিচার করেছিলেন। তাঁর মতে, “যতক্ষন পর্যন্ত আমি নিশ্চিত হইনি যে আমি সত্যিকার অর্থেই বুদ্ধজ্ঞান লাভ করেছি, আমি ধর্ম প্রচারে রত হইনি।

৪) মাত্রাজ্ঞঃ তিনি দায়ক-দায়িকাকতৃক দানকৃত চতুর্প্রত্যয় গ্রহনে মাত্রাজ্ঞ হন। নিজের পছন্দ ও অপছন্দের উপর ভিত্তি করে চতুর্প্রত্যয় গ্রহন ও বর্জন করেন না। স্বকীয় আধ্যাত্মসাধনা চালিয়ে নিতে যতটুকু প্রয়োজন তিনি শুধুমাত্র তততুকুই গ্রহন করেন। বুদ্ধ বলেছেন, “ভিক্ষুগন যখন যথালব্ধ চতুর্প্রত্যয়ে সন্তুষ্ট না থেকে ভাল ভাল চীবর, খাবার, শয্যাসন ও পথ্যাদির আশায় শহর নগরের দিকে ধাবিত হবেন তখন আমার শাসন অধঃপতনের দিকে এগুবে।”

৫) কালজ্ঞঃ কালজ্ঞ হওয়া মানে – তিনি একজন ভিক্ষু হিসেবে তাঁর দৈনন্দিন অবশ্যকরনীয় কর্তব্যের প্রতি সচেতন থাকেন। যেমনঃ কখন সূত্রাদি পাঠ করা উচিত; কখন ধর্মালোচনা করা উচিত; কখন ভাবনাবিরত হওয়া উচিত; কখন পিণ্ডচারনে যাওয়া উচিত ইত্যাদি।

৬) পরিষদজ্ঞঃ তিনি শুধুমাত্র ধর্মের অধ্যয়ন ও অনুশীলনে রত থাকেন না। তিনি জানেন যে বুদ্ধের এ শিক্ষা শুধুমাত্র আত্মোপলব্ধিতে সীমীত রাখার জন্য নয়, পরকল্যাণে প্রচারের জন্যও। তাইজন্য তিনি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সম্পর্কে অবগত হন যে, এটা ক্ষত্রিয় পরিষদ, এটা ব্রাহ্মন পরিষদ, এটা গৃহপতি পরিষদ, এটা শ্রমণ পরিষদ ইত্যাদি। এবং এই বিভিন্ন পরিষদের মাঝে কিভাবে বা কখন উপস্থিত হওয়া উচিত; কিভাবে বা কোন বিষয়ে কথা বলা উচিত বা অনুচিত ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অবগত হন।

৭) অপরাপর পুদ্গলজ্ঞঃ তিনি শুধু বিভিন্ন পরিষদ সম্পর্কে জেনে ক্ষান্ত হন না, বরঞ্চ ধর্মশ্রবনে আগ্রহী ও অনাগ্রহী প্রতিটি ব্যাক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত হন। যেমন, কেউ আর্যদের দর্শনেচ্ছুক, কেউ দর্শনেচ্ছুক নয়। দর্শনেচ্ছুকদের মাঝে কেউ সদ্ধর্ম শ্রবনেচ্ছুক, কেউ নয়। সদ্ধর্ম শ্রবনেচ্ছুকদের মাঝে কেউ মনযোগী, কেউ নয়। মনযোগীদের মাঝে কেউ শ্রুতজ্ঞান অন্তরে ধারন করে, কেউ করে না। শ্রুতজ্ঞান অন্তরে ধারনকারীদের মাঝে কেউ তা স্বকীয় জ্ঞানে নিরীক্ষণ করে, কেউ করে না। কেউ নিরীক্ষিত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ধর্মানুরূপ আচরন করে, কেউ তা করে না। ধর্মানুরূপ আচরনকারীদের মাঝে কেউ আত্মহিত ও পরহিত উভয়হিতে নিজেকে নিয়োজিত করে, কেউ শুধুমাত্র আত্মহিতে প্রতিপন্ন, পরহিতে নয়। এভাবে সে ভিক্ষু লোকের বা পুদ্গলের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য জ্ঞাত হয়ে ধর্মদানে ব্রতী হন।

এ সপ্তগুনের অবিরত ও অবিশ্রান্ত অনুশীলন একদিকে যেমন একজন ভিক্ষুকে প্রকৃত বুদ্ধের অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলে, তেমনি অন্যদিকে তাঁকে একজন সুনিপুন শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করে। এবং এভাবে সে আজীবন নিজের ও অপরের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে।

*****************************

তথ্যসুত্রঃ

১) বড়ুয়া, শ্রী বেনীমাধব। (১৯৪০)। সুত্রপিটকে মধ্যম নিকায় (১ম খন্ড)। কোলকাতাঃ যোগেন্দ্র রূপসীবালা ত্রিপিটক বোর্ড।

২) বড়ুয়া, সুমঙ্গল। অঙ্গুত্তর নিকায় (৪র্থ খন্ডঃ ৭ম, ৮ম, ৯ম নিপাত)।

৩) মহাস্থবির, শান্তরক্ষিত। (১৯৭৫)। বুদ্ধের প্রধান প্রথম দুটি বানী। আন্দরকিল্লাঃ হাবিব প্রিন্টিং প্রেস।

৪) মহাস্থবির, ধর্মাধার। (১৯৯৫)। বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন। কোলকাতাঃ ধর্মাধার বৌদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশনী।

—ভিক্ষু জ্ঞানবোধি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s